ব্লগে আমার কাছের মানুষগুলো হয়তো জানেন আমি কোরিয়া থেকে অষ্ট্রেলিয়ায় চলে এসেছি পিএইচডি’র জন্য। এ আসাটা কিন্তু শুধু ভালো একটা সুযোগ লুফে নেয়া নয়। পেছনে আছে অনেক কষ্ট, কিছু লোকের মিথ্যাচার-ভন্ডামী আর নিজের ভবিষ্যত ভাবার চাপ। তাই নিয়ে একটা সিরিজ শুরু করছি। টেনে নেয়টাই হবে চ্যালেন্জ।
সিরিজটা কোন জাতি-গোষ্ঠিকে আঘাত দেয়া বা খারাপ ভাবে উপস্থাপনের জন্য নয়, একান্তই আমার নিজস্ব অভিজ্ঞজ্তা আর উপলব্ধি বলে যাওয়া। শুধু জানার জন্যই জানুন, কেউ হয়তো সাবধান হতে পারবেন। এটাই যথেস্ঠ।
উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ কোরিয়ার যাওয়ার প্রেক্ষাপট ও যোগাযোগ
যে পেশায় আছি তাতে শিক্ষা-গবেষনায় একটা বড় ডিগ্রী না হলে হয় না। ক্যারিয়ারকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে খুব দরকার একটা পিএইচডি। নিজের তো অত টাকা নেই, তাই রেজাল্টের উপর ভরসা করে বিভিন্ন দেশে স্কলারশীপের আব্দার। এ আব্দার সহজেতো পুরন হয়না, রেজাল্টের সাথে লাগে নিজেকে সঠিকভাবে উপস্থাপন আর ভাগ্য অবশ্যই। আমার কেন জানি সব মিলছিলো না। টার্গেট ছিলো ইউরোপ, সেই ভাবেই এগুচ্ছিলাম, একটা অফার কানের খুব কাছ দিয়ে বের হয়ে যাবার পর টনক নড়লো, বুঝলাম এইভাবে দেরী হয়ে যাচ্ছে। সাথের অধিকাংশই দক্ষিন-পুর্ব এশিয়া টিক দিয়ে পরীক্ষায় পাশ করে যাচ্ছে আর আমি যেখানেই টিক দিচ্ছি, উত্তর ভুল হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা প্রেশার মনের উপর। বিয়ে করে ফেললে তো আরও।
খুব কাছের কয়েকজন যখন কোরিয়া চলে গেলো, তখনও আমার কাছে ক্লিয়ার না কোরিয়ার রিসার্চের রেপুটেশন। আমার তখন ফ্রাসটেশন চলে আসছিলো। ওরা গিয়ে বললো সব ঠিক আছে, চলে আয়। আমার “এটিপি (অল টাইম পজিটিভ)” একজন সিনিয়র কলিগ আছেন, আলাপ করলাম, উনি ভ্রু কুচকে বললেন “দেখো, তবে তাড়াহুড়ো করো না”। মনটা অর্ধেক সায় দিয়েই ছিলো, এবার পুরোটাই রাজী। কোরিয়ান ভার্সিটির ওয়েবসাইটগুলো ঘুরে লেখা শুরু করলাম।
খুব দ্রতই কয়েকটা পজেটিভ রিপ্লাই পেলাম, এর মধ্যে একজন ফুল প্রফেসর, আর কাজও খুব রিলেটেড। সিলেক্ট করলাম তাকেই। পুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির। ওয়ার্ল্ড রেন্কিং এও আছে। আমি স্মার্ট লোকদের পছন্দ করি, লোকটার ছবি আর এ্যাপিয়ারেন্স দেখলাম, খুব স্মার্ট। সে ওয়েলকাম জানালো আর বলে দিলো তার একজন স্টুডেন্টের সাথে যোগাযোগ করতে (মেইলে cc দিয়ে)। ইষ্ট এশিয়ান কালচার। প্রফেসররা কিছুটা দুরত্ব মেনটেইন করেন। যাহোক, সেই পিএইচডি ষ্টুডেন্টের নাম কৃষ্ণা, নেপালী। শুরু হলো মেইলে যোগাযোগ।
আমি প্রথমেই জানতে চাইলাম ল্যাবের বর্তমান রিসার্চ এরিয়া কি? স্পেসিফিক কি কাজ হচ্ছে, আর স্কলারশিপের ব্যাপারটা কি? কিভাবে, কখন আবেদন করতে হয়? কৃষ্ণা কিছু রিসার্চ পেপার পাঠালো, অন্য প্রশ্নের উত্তর নাই। তারও ব্যস্ততা আছে। এভাবে প্রতিনিয়ত মেইলে যোগাযোগ, সব ব্যাপার বলে, স্কলারশীপের কথাটা এড়িয়ে যায়। আমার ‘এটিপি” কলিগের সাথে আলাপ হয়, উনি বলেন সাবধানে হ্যান্ডেল করতে। আমি সাবধানে হ্যান্ডেল করি।
এরই মাঝে এডমিশনের জন্য কি কি লাগবে তার নিয়ে আলাপ চলছে, কৃষ্ণা একটু ভীতু টাইপের, তাই দরকারি-অদরকারি সব ডকুমেন্টস যোগার করতে বলে, আমি একের পর যোগার করি। সেটাও খুব মজার। ওটা এখানে বল্লাম না। রিসার্চ প্রপোজাল নিয়ে কথা হয়, জিজ্ঞেস করি বারবার, লেখতে হবে কিনা? বল্লে লেখে ফেলি। এটাও এ্যাভয়েড করে। মনে আছে আমার, কয়েকদফা কাগজ-পত্র পাঠাতে হয়েছিলো। এর মধ্যে দাদা ডাকা শুরু করলাম। অন্য আর একটা ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া আমার এক বন্ধু বউ-বাচ্চার কথা মনে করে কাঁদে আর কোরিয়ার প্রশংসা করে। আমার বৃহস্পতি তখন তুংগে।
যাহোক, আসল সময় আসলো, স্কলারশীপের কথা। এতদিন টাকা-পয়সার কথা এ্যাভয়েড করতে সমর্থ হলেও এডমিশনের কাগজ-পত্র ফাইনাল করতে গিয়ে চেয়ে বসলো টাকা! বেশী না পরিমানে, ৫০ ইউএস ডলার, তবে এটা একটা মেসেজ, ভবিষ্যতের। আমিও ছেকে ধরলাম, এতদিন পর উল্টা টাকা চেয়ে পাঠাচ্ছো? আমি কিভাবে চলবো তা তো কিছু বলছো না! কিসের ভিত্তিতে আমি টাকা পাঠাবো? তোমরা এত লুকোচুরি খেলছো কেনো? আমার কথা গুলো হজম করতে ৩দিন সময় নিলো। এরপর বললো, ‘তুমি ল্যাব রুল অনুযায়ী এডমিশনের জন্য ৫০ডলার দিবে, মান্থলি পাবে ৫০০ ডলার, এসে স্কলারশীপের এ্যাপ্লাই করবে, তোমার রেজাল্ট-IELTS স্কোর-পাবলিকেশন আর প্রফেরসরের রেপুটেশনের জন্য স্কলারশীপ পাবার সম্ভাবনা ১০০ ভাগ। স্কলারশীপ ৯০০ ডলার, তখন প্রফেসর তোমার টিউশন ফি দিয়ে দিবে, ইভেন তোমার পারফরমেন্সে খুশী হয়ে আরও কিছু এড করে দিতে পারেন।” প্রথমে থমকালাম, মাত্র ৫০০! আর নিজের স্কলারশীপের ব্যবস্থা না করে কি যাওয়া ঠিক হবে? আরেকজনের মুখের কথার উপর বিশ্বাস করে? বিশ্বাস কিন্তু করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। স্কলারশীপ পেলে তো পুরো ৯০০ আর প্রফেসর নিজের ফান্ড থেকে কিছু নাকি দেবে! কোরিয়ায় থাকা আর ডিগ্রি করে আসা কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ হলো, উনারা বললেন, বলেছে যখন তখন বিশ্বাস করো, স্কলারশীপ পেলে তোমাকে আর পায় কে? আর এই টাকাতেও দুইজন চলতে পারবে(!)। শুধু একজন ঐ ইউনি থেকে মেইল করে বল্লো আবার ভেবে দেখতে, প্রফেসর নাকি সুবিধার না। সংখ্যাতত্ত্বে হেরে গেলো সে, আর মনে হলো লোকটা আমার ভালো যায় না, হিংসুক, ইত্যাদি। আমি একপা দিয়েই ছিলাম, এবার দু’পায়েই রাজি। রাজি হলাম, ৫০ ডলার পাঠিয়ে দিলাম। ২০০৬ এর অক্টোবরে। ডিসেম্বরে জানালো এডমিশন হয়ে গেছে, সব ঠিক ঠাক। মার্চ থেকে সিমেস্টার শুরু, আমি আরো আগে গেলে ভালো, রিসার্চ শুরু করে দিতে পারবো।
আমি আকাশে উড়ছি, বাবা-মা-বউ আর এটিপি স্যারের সাথে আলাপ করে ঠিক করলাম, জানুয়ারী তে যাবো, এপ্রিলের মধ্যে বউকে নিয়ে যাবো…..। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।
আমি আসলেও বোকা ছিলাম, খুব বোকা। বোকা আর সরল, খুব সহজে মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলার মত। আমার ভবিষ্যতটাও সেভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলো। শুরু হলো আমারও প্রস্তুতি…।
No comments:
Post a Comment