প্রিয় উক্তি......

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়..........

Thursday, December 18, 2008

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-৪)

এখন থেকে দিনপঞ্জীর মত ধারাবাহিকভাবে ঘটনা গুলো আর বলবো না, একেকটা বিষয় নিয়ে বলে শেষ করে যাবো। না হলে অনেক পর্ব হয়ে যাবে, ঝুলেও যাবে। আজ বলবো শুধু ডরমেটরী নিয়ে।

ডরমেটরী ব্যবসা

প্রথম রাতটা ভালোই ঘুম হলো, উঠে গেলাম সকাল সকাল, ৬.০০টার দিকে। অভ্যেস ছোটবেলার। মনে হলো ল্যাবে যাওয়ার আগে বাসাটা একটু দেখে নেই। প্রচন্ড ঠান্ডা রুমে, মোটাসোটা কিছু কাপড় চাপিয়ে রুম থেকে বের হলাম ল্যাবের ডরমেটরী দেখতে। এবার তাহলে ডরমেটরী নিয়ে ডিটেইলস বলিঃ

আমি নীচ তলায়, এখানে তখন ৩টা বেড রুম। আছে আরো দুইটা তবে একটা কিচেন বানানো হয়েছে, আরেকটা ষ্টোর-মানে যার যা এক্সট্রা তা ফেলে রাখে। আমি ছাড়া আপাতত একজন শুধু নীচ তলায় থাকতো, নাম ইয়াংতে। ঐ সময় সে জাপানে ছিলো, তাই দেখা হয় নি। খুব ভালো ছেলে। উপরের তলায় কৃষ্ণা তার ফ্যামিলি নিয়ে (বউ আর বাচ্চা), আর তিনজন মেয়ে, ল্যাবের পিএইচডি স্টুডেন্ট।

কিচেন বলতে আলাদা কিছু না, রুমটাতে একটা গ্যাসের ওভেন, একটা মাইক্রোওয়েভ আর একটা ফ্রিজ। সব ইয়াংতের। অন্যদের ব্যবহার করতে দেয়। কোন সিন্ক বা ধোয়াধুয়ির ব্যবস্থা নেই, কারন পানির একমাত্র সোর্স হলো বাথরুম। কমন স্পেসে একটা টিভি আছে, ওটাও ইয়াংতের। বাথরুমটা মাঝারী সাইজের, তবে ইয়াংতের ওয়াশিং মেশিনটা বিশাল জায়গা নিয়ে নিয়েছে। ওটা থাকায় বাচোয়া, ডরমের সবাই কাপড় ধোয়ার কাজটা সহজে করতে পারে। গরম পানির ব্যবস্থা গ্যাস হিটার দিয়ে।

কয়েকদিন ওখানে থেকে ডরমেটরী কেন্দ্রিক ব্যবসাটা টের পেলাম। ডরম ল্যাব থেকে কিছুটা দুরেই, এক পাহাড়ের ঢালে। ওখান থেকে নেমে আরেক পাহাড়ে উঠে তবেই ল্যাব। সময় লাগতো ১৫ মিনিট, তবে প্রচুর পরিশ্রমের, পা ব্যাথা হয়ে যেতো। আমার জুতো ঐ পাত্থরে রাস্তায় ক্ষয় হয়ে গেলো কয়েক মাসেই। ওজনও কমে গিয়েছিলো ৭ কেজি প্রথম এক মাসেই। এত দুরে ডরম নেয়ার কারন কি? আছে, পরে বলছি।

কোরিয়ায় যারা ছিলেন বা আছেন তারা জানেন সেখানকার বর্তমানের এ্যাপার্টমেন্ট কালচার। সব ছোট-খাটো সব বাড়ি ভেংগে বহুতল বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। এজন্য সেসব বাড়ির মালিকদের ক্ষতিপুরন দেয়া হয়। বাড়িটা ব্যবহৃত অবস্থায় ভাংগার জন্য নিলে টাকা বেশী।

আমরা যে বিল্ডিংটাই থাকতাম সেটা আগে রেস্টুরেন্ট ছিলো, ভারসিটিরই এক শিক্ষকের বাড়ী। এই এলাকাটাও ভেংগে বহুতল এ্যাপার্টমেন্ট হবে, তাই ভাড়াটিয়ারা আগেই ঝামেলা চুকিয়ে চলে গেছে। নিজের বাড়ি হলেই কেউ থাকছে, না হলে না। আর কেউ না থাকলে ক্ষতিপুরন কম পাবে নিদ্ধিধায়। এখানেই চুক্তি হলো আমার আর ঐ প্রফেসর এর। আমার প্রফেসর ঐ বাড়িটা ভাড়া নিলো একবারে কিছু বন্ড হিসেবে দিয়ে, তবে মাসিক ভাড়া দিতে হবে না, আর চুক্তি শেষে বন্ডটা ফেরত পাবে। বাড়িওয়ালা তাতেই খুশী কারন সে ক্ষতিপুরন বেশি পাবে আর বন্ডের টাকাটা আপাতত কোথাও ইনভেস্ট করতে পারবে। এটা কোরিয়ায় কমন একটা প্র্যাকটিস, বেশি বন্ড দিলে অনেকসময় ভাড়াই দিতে হয় না, বরং শেষে পুরো বন্ড ফেরত পাওয়া যায়। লাভ দুইজনেরই।

এই বাড়িটাই সে ব্যবহার করছে ল্যাব ডরমেটরি হিসেবে। বর্ডার একেবারে বাধা, তার স্টুডেন্টরা। তাদের কাছ থেকে এস্টাবলিশমেন্ট কস্ট নেয় ১০০ ডলার, মাসিক ভাড়া ১০০ ডলার মানুষ প্রতি। কেউ ফ্যামিলি নিয়ে থাকলে ফ্যামিলি মেম্বারদেরও ধরতে হবে আলাদা ভাবে। গ্যাস-বিদ্যুত-পানির বিল যা আসবে সবাই মিলে দিতে হবে। কৃষ্ণা বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকতো তাই বউয়ের জন্য আলাদা ভাড়া দিতে হতো, বাচ্চাটার জন্যও নিতে চেয়েছিলো, কৃষ্ণা অনঢ় থাকায় পারে নি।

মাসিক ভাড়া তাই প্রতি জনে ১০০ডলার, সাথে বিদ্যুত্-পানির বিল। যেহেতু এ দুটি ইউটিলিটির একাউন্ট পারসোনাল বা ফ্যামিলি ইউজার হিসেবে করা তাই ডরমে থাকা সাতজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের বিদ্যুত-পানির ব্যবহার সব-সময়ই একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতো, বিল হয়ে যেতো ডবল রেটে। অতিরিক্ত ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য এই ডবল রেটের নিয়ম। ফলাফল, বিল আসতো অনেক বেশী। প্রতি মাসে ১০০ ডলার ভাড়ার সাথে ২৫-৪০ ডলারের ইন্ডিভিয্যুয়াল বিল আসতো। এই টাকায় অন্য কোথাও কারো সাথে শেয়ারে থাকা যেতো ভালো ভাবেই।

ডরমেটরী এত দুরে নেয়ার কারন তাই সহজচুক্তিতে বাড়ি পাওয়া, কম টাকায় দফারফা, বাধা ভাড়াটিয়া। আরো আছে, যেমনঃ

# এত দুরে বাসা হওয়ায় কেউ খুব বেশি বার ল্যাব-বাসা করবে না। তাই ল্যাবে একবার এলে সহজে বাসায় যাবে না। যাবে একেবারে রাতে। তাহলে কাজ বেশি করবে।
#এত ঠান্ডাতেও হিটার ঠিক করা হয় না, কারন সবাই তাই এত তীব্র শীতে বাসায় কম সময়ই কাটাবে।

এগুলো আমার বানানো না, ল্যাবের সিনিয়র ষ্টুডেন্টদেরই কথা। কারন এর চেয়ে কাছে বাসা পেলেও নেয় নি সে।

কয়েকদিনেই ঠান্ডায় কাহিল হয়ে, আর বাসার এই দুরত্ব-সংগীন অবস্থা দেখে ঠিক করলাম আলাদা থাকবো। ভারসিটির ডরমেটরীতে থাকলে শুধু ১০০ ডলার দিলেই হয়, কিন্তু খাওয়া-দাওয়া সমস্যা। বাইরে খেতে হয়। একটু বেশি চার্জ পড়ে। সবচে ভালো দেশী কারও সাথে, না হলে প্রতিবেশী দেশের ছাত্রদের সাথে শেয়ার করে থাকা। কৃষ্ণার সাথে আলাপ করলাম। সে হাসে আর বলে এখনও বুঝো নাই……। আমি বারবার চেপে ধরায় বল্লো আমাকে ডরম ছাড়ার অনুমতি দেয়া হবে না। মগের মুল্লুক নাকি! আমি ক্ষেপে গিয়ে বল্লাম, কেনো? কিভাবে আটকে রাখবে?

আটকে রাখার পদ্ধতি খুব সহজ। ১০০ ডলার বাসা ভাড়া কেটে রেখে আমাকে দেয়া হচ্ছে ৪০০ ডলার, আমি ঐ বাসায় না থাকতে চাইলেও এই ১০০ ডলার ওরা কেটে রাখবে। এটা ল্যাব রুল! ল্যাবের সব স্টুডেন্টরা দিতে বাধ্য। আর ৪০০ ডলার দিয়ে বাসা ভাড়া করে-খেয়ে দেয়ে বাচা খুব কষ্টকর। সো আমি বাধ্য, সবাই এভাবেই বাধ্য! অক্ষম রাগে মাথার চুল ছিড়ি। আমি মুল স্কলারশিপ পাবার আগে তখন প্রজেক্টে রিসার্চার হিসেবে ছিলাম। তাই সব নিয়ন্ত্রন প্রফেসরের হাতেই। কৃষ্ণা সহ বাকি ল্যাবমেট যারা ঐ বাসায় থাকতো, সবারই একই অবস্থা। রিসার্চার হিসেবে ঘানির বলদের মত চলা। নিজেরা গুজগুজ-ফুসফুস, আর প্রফেসরের সামনে অতি বাধ্য। স্যালারীর নিয়ন্ত্রন যে তারই হাতে।

মুল মালিককে কোন ভাড়া দিতে হয় না, বাধা ভাড়াটিয়ারা বিনাবাক্যব্যায়ে সব মেনে নেয়, এস্টাবলিষ্টমেন্ট চার্জটা তো উপরি। এক্সট্রা ইনকাম। কি অসাধারন ব্যবসা। টাকা যা দেয়, ঘুরে ফিরে নিজে নিয়ে নেয়।

মনের মধ্যে একটা জেদ তৈরি হয়েছিলো। এভাবে ঘাড় গোঁজ করে বাচা যায়? একেবারে কিছু না বলে মেনে নেবো? কি করা যায়?

যখন বুঝতে পারলাম ঐ হিম-নরকে থাকতেই হবে নিজের স্কলারশীপ না পাওয়া পর্যন্ত, তখন এস্টাবলিসমেন্ট চার্জটাকে কাজের লাগানোর বুদ্ধি মাথায় এলো। আসার কয়েকদিন পর একদিন সোজা প্রফেসরের রুমে গিয়ে বল্লাম, আমার খুব ঠান্ডা লাগছে বাসায়, কোন হিটার নেই, আমার জন্য একটা গ্যাস হিটার কেনা হোক। এস্টাবলিসমেন্ট চার্জটা তো এইকাজেই নিয়েছে। সে তো রাজি না, প্রথমে গাই-গুঁই করলো, আমিও নাছোড়বান্দা, আমাকে নিজে কিনে নিতে বলে, সবাই কিনেছে। আমিও ঐ চার্জটার যৌক্তিকতা বুঝাই। তখন নতুন নতুন, সবার মত ভয়-ডর পাই না। একসময় বিরস মুখে মানতে বাধ্য হলো সে। তার সেক্রেটারীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ইয়াংজে কে অনুরোধ করে (গাড়ীর জন্য) কৃষ্ণা সহ গিয়ে কিনে আনলাম। আমার একটা বিজয়। কেনার পর ইয়াংজে হাসে, কৃষ্ণা গান গায় “তুমছে আচ্ছা কৌন হ্যায়……..” আর বলে, “ইতনে দিন তুম কাহা থে? গুরুকো তো বোল্ড আউট কার দিয়া।”

এই জেদটা শেষ পর্যন্ত ছিলো, ধাক্কা আর একটা দিতে পেরেছিলাম স্কলারশীপ পাবার পর। সময় মত তাও বলবো।

পরের পর্বঃ ল্যাব রুল ও ল্যাব ম্যানেজমেন্ট

No comments:

Post a Comment