প্রিয় উক্তি......

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়..........

Tuesday, December 30, 2008

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-৮)

আমার কোর্স এন্ড রিসার্চ এক্টিভিটিস-তিক্ততার নতুন পর্ব শুরুঃ ২য় কিস্তি

সেদিন ছিলো ফেব্রুয়ারী মাসের কোন এক শুক্রবার, ক্যালেন্ডার দেখলে আজও ডেট বলে দিতে পারবো। সেদিনই হাতুড়ি নিয়ে সিমেন্টের দেয়াল ভাংগা। দেশে থাকতে নির্মান শ্রমিকদের এই ধরনের কাজগুলো দেখতাম দাড়িয়ে দাড়িয়ে, আর এখানে গবেষনা করতে এসে করতে হচ্ছে। আমার ধারনা আমি বোধশুন্য হয়ে গিয়েছিলাম, অথবা আর সবার মত ভীতু! তবে কাজটা করে যে ভালো লাগেনি তার প্রমান এই প্রথম ঘটনাটা প্রকাশ করলাম। নিজের পরিবার-বন্ধুবান্ধব কেউই জানতো না। এইবার হয়তো জানবে।

বেঞ্চ-শেলফ ভাংগার মাঝে মাঝে সিল চা নিম ভিটামিন ড্রিংক খাওয়ায়, ভাংগা শেষে লান্চ করাবে, প্রফেসরের নির্দেশ। এটা ওদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য, কাজ করালে খাওয়াবে। আমার ততক্ষনে রাগ ফিরে আসছে, খাওয়ার ইচ্ছা নেই…কৃষ্ণা বুঝে জোর করে ধরে নিয়ে গেলো। লাঞ্চটা তড়িঘড়ি করে সেরেই ছুটলাম দুরবর্তী মসজিদে, শুক্রবার জুম্মাবার। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ায় সাবওয়েতে ওঠার আগেই ফিরে এলাম। বাসায় ফিরে থম মেরে বসে রইলাম কিছুক্ষন। এরপর ল্যাব। ওখানে আরেকজনের স্বপ্নভঙ্গের আয়োজন চলছে।

সকালেই ল্যাবে বলে দেয়া হয়েছিলো লাঞ্চের পর সবাইকে গ্লাস-হাউজে যেতে, কাজ আছে। ভালারমাথি তখন একেবারেই নতুন, ১-২ দিন হলে এসেছে। তাই সে খুব এক্সসাইটেড, গ্লাস হাউস শুনতে ভালই লাগে, আর ওখানে কোন কাজ মানেই রিসার্চ নিয়ে কিছু হবে। সে আগে-ভাগে লাঞ্চ সেরে সবার সাথে গিয়ে হাজির, রিসার্চটা হলো ভাঙ্গা সিমেন্টের ব্লক গুলো বস্তায় ভরে সরাতে হবে। ওর চেহারা দেখার মত হয়েছিলো, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা আর অনাকাঙখিত ঘটনার ধাক্কায় বিবর্ন। ওরা গ্লাস-হাউজে যাওয়ার একটু পর আমি হাজির। আমাকে দেখে বেচারী কাঁদো কাঁদো, বল্লো, এগুলো তোমাকে দিয়ে করিয়েছে, এটাই রিসার্চ! আমি শুকনো হাসি দেই। সেদিন থেকে আসলেও সবার মত ভীতু হয়ে গেলাম। আগের চেয়ে উৎসাহ কমতে থাকলো। আমার এই চেঞ্জ প্রফেসর ঠিকই খেয়াল করছে।

তো হোসাং-কে সাইজ করতে হবে, সে বীজ না দিলে এরপর রাজ-মিস্ত্রীর কাজও করতে বলবে। কাজে লাগালাম ভালারমাথি কে। কোরিয়ানরা জাতে মেয়েদের প্রতি দুর্বল, বুড়া থেকে জোয়ান, উচ্চশিক্ষিত থেকে অল্পশিক্ষিত, সব। ভালারমাথি তাই জিজ্ঞেস করতেই লিষ্ট বের হলো, কোন ওভেনে আর স্টোরে কোন মিউট্যান্ট-এর বীজ আছে। ওখানেও অনেক ঘাপলা, আমাদের দুইজনের সিলেক্ট করা মিউট্যান্টগুলোর অধিকাংশরই বীজ নাই, কোনটার ছড়া আছে, কিন্তু সব দানাই চিটা। আবারও হতাশ। প্রফেসর জানে সব বীজই আছে। আমি এইবার দেরি করলাম না, সরাসরি প্রফেসরকে বল্লাম, ফলাফল হোসাং নে! নে! (জ্বী! জ্বী!) করতে করতে ঝাড়ি খেলো। তাও যে কয়েকটা পাওয়া গেলো তাই দিয়ে শুরু করলাম কাজ।

এর মধ্যে একটা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স হয়ে গেলো, আয়োজক ইউনি আর প্রফেসরের মুল রিসার্চ সোসাইটি। নামে ইন্টারন্যাশনাল হলে আসলে কোরিয়ানরা নিজেদের ভাষাতেই প্রেজেন্ট করলো। ওটাও হাসির খোরাক দেয়। সুওন থেকে আমার বন্ধু এলো সেই কনফারেন্স-এ। একটু শান্তি!

সব বিবেচনা করে ঠিক করে ফেল্লাম বউকে এখন আনবো না, সে প্রেগন্যান্ট, ওখানে কেয়ার নেয়ার কেউ নেই, আর টাকাতো বড় সমস্যা। ওর কেয়ার আর বাচ্চা রেয়ার, কোনটাই এই টাকায় হবে না। বুঝিয়ে বলি, স্কলারশীপ পেলেই নিয়ে আসবো।

একদিন কফি খাওয়া নিয়ে প্রফেসর একটা ছ্যাচড়ামী করলো। বেসিনের কাছে রাখা ইনস্ট্যান্ট কফির স্যাসে খুব দ্রুত শেষ হয়ে গিয়েছিলো, আমি ততদিনে কফি কমিয়ে দিয়ে চা’এর জন্য হা-পিত্যেশ করছি, দেশ থেকে কুরিয়ারে “ইস্পাহানী মির্জাপুর” টি-ব্যাগ পাঠানো হবে। তো কেউ কফি চুরি করলো নাকি নিজস্ব স্টকে রাখলো, তা দেখার জন্য প্রফেসের সবার ডেস্ক আর ড্রয়ার খুলে দেখলো, হায়রে ছোটলোক! এর দুদিন পর আমি কুরিয়ারে চা পেলাম। কোরিয়ায় রেডটি তেমন পাওয়া যায় না, নানারকম গাছপালার পাতা আর ফুলের পাপড়ি ওদের চা, তার সাথে ইদানিং গ্রীনটি। সিল চা নিম মাঝে মাঝে একটা করে টিব্যাগ নিতো, একদিন প্রফেসরের সামনে আমাকে বল্লো যেন প্রফেসরকে চা বানিয়ে খাওয়াই (রেনা কফি বানিয়ে খাওয়ায়!), প্রফেসর আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি উত্তরই দিলাম না।

মার্চের ১ তারিখে ওরিয়েন্টেশন হয়ে ফার্ষ্ট সিমেষ্টারের ক্লাশ শুরু হলো। কোরিয়ান ল্যাংগুয়েজ মাস্ট। সাথে ৩টা কোর্স। ৩ ক্রেডিট করে মোট ৯ ক্রেডিটের। ৪ সিমেষ্টারে ৩৬ ক্রেডিট। একটা কোর্স নিজ প্রফেসরের, প্রতি সিমেষ্টারেই তার কোর্স নিতে হবে। বাকি দুইটা কোর্সের একটা শুধু সেমিনারে প্রেজেন্ট হতে হয়, আর পেছনে বসে ঘুমালেই হয় (জনপ্রিয় পদ্ধতি!), আর দায়িত্বে থাকা শিক্ষককে মুখ দেখালেই এ+। ৩য় কোর্সটা তৎকালীন হেড এর। নিজেকেই একটা টপিক নিয়ে প্রেজেন্ট করতে হবে। শেষ দুইটা কোর্সের মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন হাংগুমাল (কোরিয়ান ভাষা), ফরেনাররা ইংলিশে বলতে পারবে।

প্রফেসরকে ক্লাসে ইংলিশই বলতে হবে, কারন আমরা ৪ জন (দুই মংগো, ভালার আর আমি) তার ল্যাবের বিদেশী স্টুডেন্ট! সে মনোঃক্ষুন্ন এই জন্য। তবে ভালো মতই শুরু হলো কোর্সটা। আগেও বলেছি সে শিক্ষক হিসেবে খুব ভালো মানের। তাই ক্লাশগুলো উপভোগ্য হচ্ছিলো, কিন্তু ৩টা ক্লাশ পরেই সে এসাইনমেন্ট দেয়া শুরু করলো। এসাইনমেন্ট মানে হলো ল্যাব ও ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট ঠিক আছে নাকি দেখা। ভালার আর বলোরামাকে দেয়া হলো ৩টা স্পেকট্রোফটোমিটারের কোনটার রিডিং কেমন, কোন মেশিন কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে। আমাকে আর যায়াকে দেয়া হলো কঠিনটা। ন্যানোড্রপ নামের খুব এক্সপেনসিভ একটা স্পেকট্রোফটোমিটার ইউজ করে ক্লোরোফিলের পরিমান বের করা। এটা দিয়ে সাধারনত ডিএনএ-আরএনএ-প্রোটিনের কনসেন্ট্রেশন বের করা হয়। এই ইন্সট্রুমেন্টটাতে যেকোন অরগানিক সলভেন্টের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, আর পিগমেন্ট তো দেয়াই যাবে না। ক্লোরোফিল নিজেই পিগমেন্ট আবার এটা এক্সট্রাক্ট করতে বিভিন্ন অরগানিক সলভেন্ট ব্যবহার করতে হয়, যেমনঃ এসিটোন, ডিএমএফ, মিথানল। জেনেশুনে এমন এসাইনমেন্ট দেয়া! যা হোক চেষ্টা শুরু হলো, প্রতিসপ্তাহে রিপোর্ট প্রেজেন্ট করতে হয়, আমিই বেশি করি, উৎসাহ আমারই বেশি।

নরমাল স্পেকট্রোফটোমিটারের চেয়ে ন্যানোড্রপে ক্লোরোফিলের রিডিং কম আসে, আমি চেষ্টা করলাম একই স্যাম্পলের এই দুটা ভিন্ন মিটারের রিডিং এর ভেতর একটা লিনিয়ার রিলেশনসীপ বের করতে, যেনো একটা কনভারশন ফ্যাক্টর বের করতে পারি। প্রতি পদে পদে সমস্যা, এখানে ডিটেইলসে গেলাম না, বিরক্তিকর মনে হবে। আমি প্রতি ক্লাশে লেটেষ্ট আপডেটে সমস্যা গুলো বলি, যায়া গিয়ে বলে “নো পব্লেম”। কারন ওর ধারনা সে পজিটিভ বল্লেই প্রফেসর খুশি হবে। ভালারমাথি আমার মতই ফ্যাক্ট তুলে ধরে, বলোরামা বলে “নো পব্লেম”। ক্লাশে যায়া আর বলোরামা ঝাড়ি খায়, আর শোনে “এমন করলে আগামী বছর আবার এই কোর্স নিতে হবে।” আমি আর ভালারমাথি শুনি “নট এনাফ, ট্রাই আ বিট মোর”। ট্রাই চলতে থাকে।

এর মাঝে নিজের প্রজেক্টের কাজ শুরু করি, ডঃ গোহ-এর সাথে কাজ শুরু করি, কৃষ্ণার সাথে কয়েকটা প্রজেক্টে একত্রে কাজ করি, একটা পেপারের কো-অথরশীপ নিশ্চিত হয় (তেমনি কথা দেয়া হয়েছিলো)। ডঃ গোহ-এর সাথে শুরুটা খুবই ভালো হয় “প্রোটোপ্লাস্ট আইসোলেশন”-এর কাজ। প্রথম কয়েকটা এ্যাটেম্পটেই ভালো ফলাফল, কিন্তু তার উপর আমার প্রফেসরের চাপ, “শিখিয়ে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও।” গোহ-এর উৎসাহে ভাটা পড়তে থাকে, প্রজেক্ট এক জায়গায়তেই ঘুরপাক খায়।

একটা ভালো নিউজ পাই এপ্রিলের ৩য় সপ্তাহে। কোরিয়ান রিসার্চ ফাউন্ডেশন-এর স্কলারশীপের সার্কুলার। মে’র ৫ তারিখ লাষ্ট ডেট আবেদন করার। প্রফেসরের সাথে আলাপ করি প্রোপোজাল নিয়ে, সে বলে নিজে লেখো, না হলে আমার কোন প্রজেক্ট কপি করে দাও। ডঃ ইসমাইলের সাথে আলাপ করে একটা আইডিয়া নিলাম, লিখে ফেল্লাম একেবারেই নিজস্ব প্রোপোজাল, নিজের পিএইচডি। প্রফেসরকে দেখালাম, সে পড়েও না, বলে, “ওকে!” সব কাগজপত্র যোগাড় করে দিই, ল্যাব অফিস চুপচাপ থাকে। আমি তো সিরিয়াস, স্কলারশীপ পেতেই হবে, পেলে বউকে নিয়ে আসবো। কারন তখন পুরো ৯০০ ডলার আমার, প্রফেসর টিউশন ফি দিয়ে দিবে, কথা ফাইনাল। একেবারে লাষ্ট-ডে’তে লাষ্ট-মোমেন্টে ওরা জমা দিলো অনলাইনে, প্রফেসরের ভাষায় ” উই লাইক টু এনজয় দা ডেটলাইন।”

এভাবে দিন যায়, মাস যায়, আমি কোর্স নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠি, আগের এসাইনমেন্ট শেষ হয়, ফাইনাল রিপোর্ট-এ বলি “ন্যানোড্রপ ক্লোরোফিল এর পরিমান বের করার জন্য সুইটেবল না”। প্রফেসর খুশি না। নতুন এসাইনমেন্ট আসে “এইচপিএলসি” নিয়ে। ওটাও চলতে থাকে। এর মাঝে আর একটা কনফারেন্স, বন্ধু আসে সুওন থেকে, আমার যাওয়া হয় না। জুন মাসের ১৫ তারিখে সিমেষ্টার শেষ। দেশ থেকে সবার অনুরোধে সিমেষ্টার শেষে একবার দেশে আসো, স্ত্রীকে দেখে যাও, আর মেজ-ভাইয়ের বিয়ের ডেট ঐসময়ই ফেলা হবে। দুটোই হবে। আমিও সিদ্ধান্ত নেই একবার ঘুরে আসি, সবাইকে দেখে আসি, ভাইয়ের বিয়েতে থাকা হবে, বউকে দেখা হবে, ডেলিভারীর সময় হয়তো থাকা হবে না।

দেশে যাওয়ার কথা প্রফেসরকে বল্লাম, ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে, আমি তো যাবই, আমার চেহারা দেখেই বুঝার কথা। প্রথমদিন বলে “লেট মি থিংক!” আমি সুজাতাদিদির হেল্প নিয়ে টিকেটি বুকিং দেই। প্রফেসর থিংক করে বলে “ওকে যাও, কয়দিন থাকবা? ১০দিনের বেশি পারবা না”। অথচ ২০ দিনের ছুটি পাই! আমি জুনের ২৮ তারিখে রওনা দেবো, ফিরবো জুলাইয়ের ১৫ তারিখে। তাই বলে দিই। এখন প্রমান দেখাতে হবে যে আমি আসলেও রিটার্ন টিকেট কেটেছি, অর্থ্যাৎ আমি ফিরে আসবো। সো টিকেটের এক কপি প্রফেসরকে দেখাতে হবে।

রিসার্চের অবস্থা খুব ভালো না। প্রোটিয়েজ নিয়ে আমার প্রজেক্টটা হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া হলো, এভাবে অতীতে অনেক প্রজেক্টই মাঝপথে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, কারন প্রফেসরই ভালো জানেন। কৃষ্ণার একটা পেপার মিস হয়ে গেছে এই জন্য, কৃষ্ণার আক্ষেপ, প্রফেসরের আক্ষেপ নেই। ডঃ গোহ এর সাথে একটা প্রজেক্ট, আর কৃষ্ণার সাথে ২টা প্রজেক্ট। মোট ৩টা চলছে।

ল্যাংগুয়েজ কোর্সের পরীক্ষায় পাস করে, কোর্সগুলোর রিপোর্ট জমা দিয়ে গুছিয়ে তৈরি হলাম দেশে যাবার জন্য। বুসান থেকে না গিয়ে আবার সুওন হয়ে ইনচোন এয়ারপোর্ট থেকে যাবো, বন্ধু কিছু জিনিসা পাঠাবে। তাই ২৭ জুন বিকালে রওনা দেবো সুওনের উদ্দেশ্যে, ২৮জুন ঢাকার উদ্দেশ্যে।

এর মধ্যে জেনে যাই কোর্সে দেয়া এসাইনমেন্ট গুলো আসলে বাধা এসাইনমেন্ট, আগের স্টুডেন্টদেরও দিয়েছে, এবং প্রফেসর জানে রিপোর্ট কি আসবে। এসাইনমেন্ট দিয়ে ব্যস্ত রেখে সিমেষ্টার শেষ করা। তার নিজের পরিশ্রম কমলো।

২৭ জুন, যাবার দিন সকালে আরেক যাদু দেখলাম। সেদিন প্রফেসর কোর্সে গ্রেডিং করে অনলাইনে দিয়ে দেবেন। ক্লাস-পারফরমেন্স আমার ভালো, এরপর ভালারমাথি। যায়া-বলোরামাকে তো থ্রেট দেয়া হয়েছে আগামী বছর আবার থাকতে হতে পারে। প্রফেসর গ্রেড দিয়েছে শুনে জিজ্ঞেস করলাম, যা জানলাম তাতে প্রথমে বিহবল, পরে প্রচন্ড রাগ এলো। এমনও হয়! বলোরামাঃ এ, যায়াঃ বি প্লাস, আমি আর ভালারঃ বি! হায়রে! এমন প্রফেসরের উপর শ্রদ্ধাবোধ থাকে কিভাবে? ভালারের গ্রেড পরে বাড়িয়ে বি প্লাস করা হয়েছিলো। ল্যাবে সবাই হাসছে, কৃষ্ণা-রেনা-কিরন-প্রকাশ-বাসু-ইয়াংজে! সুজাতাদিদি শকড্! সবার চোখের সামনে গত কয়েক মাসে যা হয়েছে, গ্রেড তার উল্টো।

সেই ক্ষোভ নিয়েই রওনা দিলাম দেশের উদ্দেশ্যে। বন্ধু বারবার বলে “ফিরে না এলে বল, আমি চলে আসবো কয়দিন পর”। আমি তখনও আশা ছাড়ি নি। দেখি না আর একটু!

চলবে……….

Tuesday, December 23, 2008

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-৭)

আমার কোর্স এন্ড রিসার্চ এক্টিভিটিস-তিক্ততার নতুন পর্ব শুরুঃ

প্রারম্ভিকা অনেক হলো, এবার মুল প্লটে ফিরে আসি। কোর্স ও রিসার্চ নিয়ে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা গুলো বলি।

তো দ্বিতীয় দিনই ল্যাবে গিয়ে প্রফেসরকে ধরলাম, জিজ্ঞেস করলাম, আমার রিসার্চ প্রজেক্ট কি হবে? উত্তর এলো, কে কি করে দেখতে থাকো আর আমাকে জানাও। এর পর ঠিক করা যাবে। এটা আমার নিজেরই ভুল হিসেবে ধরছি, নিজের রিসার্চ প্রজেক্ট কি হবে নিজেই জানি না, যদিও আমি বারবার জিজ্ঞেস করায় বলা হয়েছিলো, সব কিছু রেডি, তুমি এসেই শুরু করে দেবে। এবার জানতে হবে সব।

মলিকুলার বায়োলজি ল্যাবের বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট আর প্রটোকল গুলোর নাম শুনেছি, থিওরী পড়া আছে, কিন্তু প্র্যাকটিকালী করা হ্য়নি অধিকাংশই। তাই চাইলেও কাজ শুরু করতে পারবো না। তাই কাজ শেখা শুরু হলো, পাবলিশড আর্টিকেল গুলো পড়ি, আর সে অনুযায়ী কাজ শিখি সুজাতাদি-রেনা-কৃষ্ণা-কিরনের কাছ থেকে। এরা হেল্পফুল, ধরে ধরে সব শেখায়। আমি শিখি আর প্রফেসরের কাছে রিপোর্ট করি, সে বলে “ওকে! ওকে!!” দেশ থেকে ফাটাফাটি রিসার্চ করার স্বপ্ন নিয়ে গেছি, আমি আরো দ্বিগুন উৎসাহের সাথে শিখতে থাকি, সব শিখে ফেলতে হবে। সেদিন গুলোর কথা মনে পড়লে এখন নিজেই হাসি।

যাহোক, আমার এমন উৎসাহ-উদ্দীপনা আর কন্টিনিউয়াস খোচানোতে ত্যক্ত হয়ে প্রফেসর বল্লো, তুমি ধানের “কাইনেজ মিউট্যান্ট” নিয়ে কাজ করো। এই মিউট্যান্ট এর বীজ কোথায় পাওয়া যাবে? রেনার কাছে। গেলাম রেনার কাছে, বেচারীর মুখ কাদো কাদো, কারন সে এটা নিয়ে কাজ আর করছে না, অনেক আগেই নিজ থেকে বাদ দিয়েছে, এটা তার পিএইচডি প্রজেক্টও না, তাই সে জানেনে এজ্যাক্টলী কি অবস্থা ঐ মিউট্যান্ট গুলোর। নেক্সট রিসোর্স পারসন হোসাং। এর সাথে প্রথম থেকেই আমার সম্পর্ক উষ্ণ না, কারন কৃষ্ণার সাথে তার সম্পর্ক ভালো না, আর আমার সাথে কৃষ্ণার সম্পর্ক ভালো। ব্যাস, হয়ে গেলো, হোসাং আমাকে বলে “আই দোন্নো!”

নেক্সট ৭দিন ধরে বীজ খুজে বেড়াই, প্রফেসরকে আর আপডেট করার কোন খবর নেই, সো প্রফেসরের ধারনা আমি ফাকি দিচ্ছি, তার টাকায় খেয়ে-দেয়ে মজা করে বেড়াচ্ছি। ইভেন আমাকে কোনো আর্টিকেল পড়তে দেখলেও ওর সহ্য হ্য় না, এসে বলবে, “হোয়াট আর ইউ ডুয়িং, ডু সামথিং, এন্ড রিড দিজ আর্টিকেলস এট হোম”। আমার রাতটাও খাবে সে।

৭দিন পর বল্লাম, বীজ নাই, কোথাও নাই। ধমক খেলো রেনা আর হোসাং। হোসাং আরো ক্ষেপা আমার উপর। ল্যাব সম্বন্ধে প্রফেসরের ধারনা এমনই, যে যার মতো তথ্য গোপন করে, সেও খোজ রাখে না। তাই প্রজেক্ট বাতিল। নেক্সট প্রজেক্ট “প্রোটিয়েজ মিউট্যান্ট”। একটা লিষ্ট হাতে পেলাম অনেকগুলো প্রোটিয়েজ মিউট্যান্ট এর। বলা হলো সিলেক্ট করো। কৃষ্ণার সাথে পরামর্শ করে কয়েকটা সিলেক্ট করলাম, কারন এগুলোতে আগে অল্প কাজ হয়েছে, এবং প্রমিজিং লাইন। আবার বীজ খোজা। এইবার আবার হোসাং। সেইই দায়িত্বে। আবারও “আই দোন্নো!”

ছোট বাচ্চার মত কিছু হলেই প্রফেসরের কাছে দৌড়ায় কে? সবার সাথে কথা বলে বের করার চেষ্টা করি। সবাই বলে হোসাং জানে, হোসাং বলে “আই দোন্নো!”। এরই মাঝে ডঃ ভাসু এসে জয়েন করলো, তার সমস্যা ভিন্ন। এসে জয়েন করলো ভালারমাথি, ইন্ডিয়ান মেয়েটা, আমার সাথে পিএইচডি শুরু করবে, তারও প্রজেক্ট দিতে হবে।

আমার উপর প্রফেসর একটু বিরক্ত, কোথায় দেশ থেকে সব কাজ শিখে এসে ওখানে ঝাপিয়ে পড়বো, তা না, এসে শিখছি। আবার সময় নষ্ট করে আর্টিকেল পড়ছি।

কম্পিউটার নিয়েও ঝামেলা। সবাই টাকা জমিয়ে ল্যাপটপ কেনে, কারন ল্যাবে কম্পিউটার অল্প কয়েকটা, আবার তার কয়েকটা অফিসের কাজে ব্যবহৃত হয়, আর কয়েকটা কোন ইন্সট্রুমেন্টের সাথে এটাচড। আমি মহাফাপরে। দিনের বেলা কৃষ্ণা বা সুজাতিদির কম্প্যুটারে সহজে এক্সেস আছে, আর রাতে কোন ল্যাব কম্পিউটারে হামলা। এই নিয়েও হোসাং এর সাথে সমস্যা। সে তখন কম্পিউটার-প্রিন্টারের দায়িত্বে। আমি কোনটা ব্যবহার করতে গেলেই ঝামেলা বাধায়, নানা ওজর দেখিয়ে মানা করে। আমিও একবার ওপেন করতে পারলে আলাদা ইউজার একাউন্ট ওপেন করে রাখি, সে আরো ক্ষেপে যায়। এই নিয়েও প্রফেসর নাখোশ, তাই ঐ দায়িত্ব আমার ঘাড়ে দিলো শাস্তি হিসাবে। আমাকে কম্প্যুটার এক্সপার্ট বানিয়ে ছাড়বে, যেনো আমি জোড়াতালি দিয়ে আমার জন্য একটা কম্প্যুটার বানাতে পারি। আমি ঐ পথ দিয়েও গেলাম না, বরং একটা ল্যাব কম্প্যুটার দখল দিলাম। হোসাং এর রাগ দেখে কে!

সেই রাগ দেখানোর জায়গা ধানের বীজ, আমার দরকার, সে দেবেনা। প্রফেসর আমাকে বসে থাকতে দেখে ক্ষেপে চুড়ান্ত। বসিয়ে বসিয়ে তো আর বেতন দেয়া যায় না, কাজে লাগাতে হবে। আর কাজে লাগানোর জায়গা অনেক আছে, কায়িক শ্রমের সুযোগ। আমাকে কাজে লাগানো হলো।

প্রফেসর বিকে-২১ এর হেড, তার আলাদা অফিস লাগবে। গ্লাস হাউজের বিল্ডিং এর ফার্ষ্ট ফ্লোরে একটা ল্যাব রুম পড়ে আছে অব্যবহৃত, সেটা টার্গেট। “সিল চা নিম” করবে কাজটা, হেল্প দরকার, আমি ফাকি দিচ্ছি, তাই আমাকে পাঠানো হলো ডেপুটেশনে। আমি গেলাম, কি করতে হবে ধারনা নেই।

গিয়ে দেখলাম রুমে সিমেন্টের তৈরি কয়েকটা বেঞ্চ ও সেলফ আছে, আর সিল চা নিম একটা বড় হাতুড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে।

বেঞ্চ ও সেলফ হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভাংতে হবে!

চলবে…………।

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-৬)

আজকের পর্বঃ ল্যাব মেম্বারদের পরিচিতি

পুরো কাহিনী শেষ করতে ল্যাব মেম্বারদের কথা বারবার আসবেই, তাই সবার একটা পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করছি।

ল্যাবে প্রফেসর লি ছাড়াও ছিলেন আরো দুইজন রিসার্চ প্রফেসর, একজন ইনভাইটেড/ভিজিটিং প্রফেসর, দুইজন পোষ্টডক্টরাল রিসার্চার, নয় জন পিএইচডি স্টুডেন্ট। স্টাফ হিসেবে হিসেবে আরো পাঁচ জন। এদের সংক্ষেপে পরিচিতি দিচ্ছি।

প্রফেসর লিঃ ল্যাবের প্রধান ব্যক্তি। পটেনশিয়াল অনেক ছিলো, খুব ভালো মানের একজন রিভিউয়ার। কিন্তু টিন-এজার টাইপ হিরোইজম, স্বেচ্ছাচারীতা, টাকা-পয়সা নিয়ে দুনম্বরী আর জীবনটা উপভোগের ধান্ধায় (খেলাধুলা আর মদ্যপান অর্থে) রিসার্চ লাইফটাই শেষ তার। সারাদিন ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। আর উকি-ঝুকি মারে কে কি করে? কার ভুল ধরা যায়? নিজের ফাকিবাজিটা ঢাকতে অন্যের উপর ঝাড়ি দেয়াই তার স্বভাব। শিক্ষক হিসেবে খুব ভালো মনের, আমাকে আধা-ঘন্টাতেই কোরিয়ান এলফাবেট সব উচ্চারন সহ চিনিয়ে দিয়েছিলো। যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করা নিঃসন্তান এই লোকটা পারত পক্ষে কারো প্রশংসা করতো না, পজিটিভ কথা বলতো না। সব সময় তার ধারনা ছিলো স্টুডেন্টরা সময় নষ্ট করছে, আর তার টাকার অপচয় করছে। কমন ডায়ালোগ “হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? ডু সামথিং”।

ডঃ ইসমাইল জুলফিগারভঃ
ল্যাবের সিনিয়র রিসার্চ প্রফেসর। প্রফেসর লি’র পরেই তার অবস্থান। আজারবাইজানের নাগরিক। খুব মেধাবী একজন সায়েন্টিস্ট, তবে জায়গামত কনফিডেন্ট না। ল্যাবের ভিতরে রাজা, সব জানেন, সব বুঝেন, আর প্রফেসর না থাকলে প্রফেসর এর মতই ভংগী নিতে ভালবাসেন। জন্ম কম্যুনিষ্ট সোভিয়েত আমলে, তাই মুসলিম হিসেবে পরিচিত হলেও প্র্যাকটিসিং না। বরং কেউ হালাল-হারাম মানলে বিদ্রুপ করেন। পাল্টা যুক্তি দিলে রণে-ভংগে দেন। নেগেটিভ পয়েন্ট বিপরীত লিংগের প্রতি তীব্র দুর্বলতা। ল্যাবেই অতীতে অনেক মুখরোচক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। ল্যাবের পুরুষ স্টুডেন্টদের সাথে কোন রিসার্চ প্রজেক্ট করতে উৎসাহী না, শুধু মেয়েদেরকেই পছন্দ। বেশি পছন্দ ছিলো মংগোলিয়ান মেয়ে দুটা। বয়স এখন ৫০ প্রায়। স্ত্রী আর দু’ছেলে নিয়ে সংসার। এই বয়সে আর কোথাও ভালো সুযোগ পাবেন না বিধায় ল্যাবেই নানা ভাবে স্থায়ী হবার চেষ্টা করেন, এই জন্যই প্রফেসর যা বলেন উনিও তার সাথে একমত, একটু তেল আরকি! এখনও বহাল তবিয়তেই আছেন!

ডঃ সুজাতা রানি মিশ্রাঃ ল্যাবের ২য় রিসার্চ প্রফেসর, ফান্ডিং পেতেন ব্রেইনপুল কোরিয়া থেকে। ইন্ডিয়ান, উড়িষ্যার, বাংলা বোঝেন, বলতে পারেন না তেমন। খুব মেধাবি-সফট হার্টেড-পরোপকারী-অবিবাহিতা-নিরামিষাশী শুকনো-লিকলিকে একজন মহিলা। ৪৫ এর মত বয়স। রিসার্চ-কেরিয়ার আর পরিবারের চাহিদা মেটাতে মেটাতে নিজের জন্য আর ভাবা হ্য় নি তার। সারারাত একাই ল্যাবে কাজ করেন, সকাল ৯-১০টার দিকে বাসায় গিয়ে ঘুমান। আবার বিকালে এসে হাজির। কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আমি দিদি বলে ডাকতাম। সত্যিকারের দিদি। যাবার পর থেকে তার স্নেহ পেয়েছি-শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তা ছিলো। আমি খুব অগোছালো, তবুও প্রতিদিন সকালে আমার ডেস্কটা গোছানো পেতাম। আমার ল্যাব ক্লিনিং-এর দিনও উনি আগে ভাগে কিছু করে আমার পরিশ্রম কমিয়ে দিতেন। প্রচন্ড নীতিবান, তবে আত্মভোলা। ল্যাবে তার এই আত্মভোলা স্বভাবের সুযোগও নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো। তার স্যালারি জমা হতো ব্যাংকে, একা মানুষ কত হলো খোজও নিতেন না, এমনি বোকা। একদিন হঠাৎ খেয়াল করলেন ব্যালেন্স নেগেটিভ হচ্ছে, বাড়ছে না। খোজ করতে বেরিয়ে এলো কেঁচো খুড়তে সাপ। ল্যাব অফিস থেকে দিদির একাউন্ট নম্বর চেন্জ করে আরেক ল্যাব স্টাফের নামে দিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তাই ২০০৬ এর শেষ থেকে ২০০৭ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত ৬ মাস তার স্যালারি জমা হয়েছে অন্য একজনের একাউন্টে। জিজ্ঞেস করলে বলা হলো ভুলে আর একজনের একাউন্ট নাম্বার চলে গেছে। মজা এখানেই ভুলে ল্যাবের একজন স্টাফের একাউন্টেই যায়, কোন বিদেশী স্টুডেন্টদের না। সেই টাকা উদ্ধার করতে দীর্ঘদিন লেগেছিলো, অনেকদিন পিছে লেগে থেকেও আরো ৬ মাস। দিদি এখন দেশে ফিরে গেছেন তার চুক্তি সম্পন্ন করে।

ডঃ চাঙ ইয়াং গোহঃ একমাত্র ইনভাইটেড প্রফেসর, কোরিয়ান। তার স্থায়ী কোন চাকুরী ছিলো না। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়েই কাজ করতেন। নিজ এরিয়ায় কয়েকটা খুব উন্নতমানের রিসার্চ পাবলিকেশন ছিলো। আমি যাওয়ার ১ মাস পর ল্যাবে জয়েন করেন। লোক ভালো, তবে শর্ট টেম্পারড। খুব দ্রুত ফেসটা লাল হয়ে উঠতো। তার সাথে আমার একটা রিসার্চ প্রজেক্ট ছিলো। শুরুটা ভালোই ছিলো, কিন্তু তার উপর আমার প্রফেসরের অব্যাহত চাপ ছিলো আমাকে দ্রুত কাজ শিখিয়ে ছেড়ে দেয়ার জন্য। যেন গোহ চলে যাবার পর আমি ঐ লাইনে কাজ করতে পারি, গোহ কে তাইলে আর টাকা দিয়ে পুষতে হবে না। এটা নিয়ে প্রফেসরের সাথে দ্বন্দ ছিলো। সেটা আমাদের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছিলো, প্রজেক্টের অগ্রগতিতেও। তাই শুরুর ৬ মাস পর আমাকে ঐ প্রজেক্ট থেকে উইথড্র করা হয়, যা আমাদের দুইজনের জন্যই স্বস্তিদায়ক ছিলো। আমার স্বস্তির আনন্দ দেখে আমার প্রফেসর খেপেছিলো খুব। গোহ একাই থাকতো ভারসিটিতে, ফ্যামিলি অনেক দুরে। সে আলাদা বাসা না নিয়ে তার চেম্বারেই খেতো, ঘুমাতো। নতুন চুক্তিতে এখন অন্য ভারসিটিতে চলে গেছে।

ডঃ প্রকাশঃ পোষ্টডক্টোরাল ফেলো, ইন্ডিয়ান, কেরালার। ফান্ডিং পেতো বিকে-২১ থেকে। মেধাবী তবে অস্থির-রগচটা আর খুব ভীতু টাইপের। প্রফেসরের সাথে সবসময়ই ঝগড়া লাগতো। ওরা কেউ কাউকে দেখতে পারতো না। তবে ঝগড়ার পর পরই ভয়ে থাকতো প্রফেসর আবার না কি করে! আগেও কয়েকটা ফেলোশীপ কমপ্লিট না করেই ছেড়ে দিয়েছে এই লোক। আমার সাথে খুব মজার সম্পর্ক ছিলো, অলটাইম আমাকে প্রফেসরের এগেইন্ষটে চার্জড আপ রাখতো আর বলতো এখানে কেন মরতে এসেছো, অন্য ভারসিটিতে চলে যাও। কৃষ্ণার সাথে প্রথমে সম্পর্ক ভালো থাকলেও পরবর্তিতে খুব খারাপ হয়ে যায়, ল্যাবের ভেতরেই বিশ্রী ঝগড়া হতো। চুক্তি শেষ ল্যাবের সাথে, চুক্তির শেষে তাকে তার অনেক প্রাপ্যই বুঝিয়ে দেয়া হয়নি, এখন পুসানেই আছে তবে ডিপেন্ডেন্ট ভিসায়, কারন তার ওয়াইফ ওখানেই পিএইচডি করছে।


ডঃ ভাসুঃ
২য় পোষ্ট ডক্টোরাল ফেলো, ইন্ডিয়ান তামিল। খুব ইয়াং। আমারই বয়সী, আগের দুইজনের মত সেও ইন্ডিয়াতেই পিএইচডি করেছে। হাসিখুশী, তবে একটু বোকা টাইপের। অন্য লাইনে পিএইচডি করায় এই ল্যাবে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারতো না, তাই হতশায় ভুগতো। সিনিয়ররা কেউ হেল্প করতো না তাকে, তাই হেল্পের জন্য পিএইচডি স্টুডেন্টদের কাছে আসতো, এইজন্যও সমালোচনা সইতো হতে বেচারাকে। বেশি দুঃখ পেলে আকন্ঠ মদ গিলে কাঁদা ছিলো অভ্যাস। সমবয়সী বলে আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো। প্রফেসরের নামকরনের সময় তার প্রস্তাব করা নাম ছিলো “মুড্ডা”, তামিল ওয়ার্ড, মানে হলো পুরুষাংগ। সেও ল্যাবের সাথে চুক্তি শেষ করে অন্য ভারসিটিতে নিজের অরিজিনাল ফিল্ডে এখন পোষ্টডক্টরেট করছে। ভালো আছে।

কিম হোসাঙঃ কোরিয়ান সবচে সিনিয়র পিএইচডি স্টুডেন্ট। টিপিক্যাল আদু ভাই। বয়স ৪২। ঐ ল্যাবেই আছে মাস্টার্স থেকে। ডিগ্রি আর শেষ হয় না। প্রফেসরের ডানহাত-বামহাত, সকল অনৈতিক কাজের বাস্তবায়ক। ওর ইয়ারমেট ডিপার্টমেন্টের হেড ছিলো, আর ও এখনও ঘানি টানছে। প্রথম থেকেই আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিলো না, কৃষ্ণার সাথে ওর খারাপ সম্পর্কে জের ধরে। যদিও শেষের দিকে সম্পর্ক ভালো হতে শুরু করেছিলো, সেটাও অবশ্য প্রফেসরের নির্দেশে।


ইউ ইয়াং জেঃ
কোরিয়ান পিএইচডি স্টুডেন্ট। বয়স ৩৮-৩৯ হবে। এই ল্যাবেই পিএইচডি শুরু করেছিলো ১০ বছর আগে, প্রফেসরের সাথে বনিবনা না হওয়ায় চলে গিয়েছিলো চাকরীতে। ১০ বছর পরে ফিরে এসে আবার কাজ শুরু করে। প্রফেসর সম্পর্কে ধারনা খুব খারাপ ছিলো, তবে সেটা প্রকাশ করতে চাইতো না। খুবই মেধাবী-মাল্টি স্কিলড একটা ছেলে। ল্যাবের সব সমস্যা সমাধানে ইয়াংজে ছাড়া উপায় নেই। রিসার্চ-কম্প্যুটার-ইলেক্ট্রিক-টেকনিক্যাল সব ব্যাপারে। আমার টেবিল টেনিস খেলার পার্টনার। কোরিয়ানদের মধ্যে সেইই একমাত্র যে অন্যের মতামতকে সম্মান দিতো। পিএইচডি শেষ করে এখন কানাডায় পোস্ট-ডক করছে। যাওয়ার আগে ল্যাবে তার তৈরি সকল এক্সপেরিমেন্টাল ম্যাটেরিয়াল নষ্ট করে দিয়ে প্রফেসরের প্রতি তার অনুভুতির চরম প্রকাশ ঘটিয়ে গেছে।


রোহ ইউঃ
আর একজন কোরিয়ান পিএইচডি স্টুডেন্ট। তবে সে কাজ করতো একটা রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। ল্যাবে মাঝে মাঝে আসতো। কারও সাথে তেমন সম্পর্ক ছিলো না।

রেনা সাফারোভাঃ ল্যাবের প্রথম বিদেশী স্টুডেন্ট, আজারবাইজানি। প্রথম বিদেশী(নি) তাই কালচারাল শকের প্রথম ধাক্কাটা সেই সহ্য করেছে। খুব হেল্পফুল, কোন কিছু শেখানোর সময় পেন্সিলটা কিভাবে ধরতে হবে তাও বলে দেবে। মাত্র ২০০ ডলার দিয়ে চলতে হতো প্রথমে। অনেক কষ্ট করেছে সে। অভাবে স্বভাব নষ্ট, তেলবাজ আর ল্যাবের জিনিসপত্র ব্যাক্তিগত কাজে ইউজ করা তার জন্য মামুলি ব্যাপার। নিজের রিসার্চের জন্য এত খরচ করে যে প্রফেসরের জন্য সে একটা মাথাব্যাথা। নিজের ভাষা আর ইংলিশ ছাড়াও কোরিয়ান-রাশানও ভালো বলতে পারে। এইজন্য সে ডবল এজেন্ট। আমাদের কথা প্রফেসরের কাছে, কোরিয়ানদের কথা আমাদের কাছে এসে বলবে। মুসলিম পরিবার থেকে এসেছে, আড়লে-আবডালে সবই প্রায় খায়, তবে আমার সামনে হালাল-হারাম মানতো। ল্যাবের মংগোলিয়ান মেয়েদুটা তাকে লিডার মানতো। এখনও ডিগ্রী হয়নি, ৫ বছরের বেশি হয়ে গেলো, আশা করছে সামনের সিমেস্টারে হবে।

কৃষ্ণা নাথঃ ল্যাবের ২য় বিদেশী স্টুডেন্ট, নেপালী। আর একটা কোরিয়ান ইউনি থেকে এখানে চলে এসেছে। দেশে ত্রিভুবন ইউনিভারসিটির লেকচারার ছিলো। খুব ভালো লোক-টিপিক্যাল বড় ভাই। খুব ইমোশনাল টাইপের লোক, সবাকে মন খুলে হেল্প করতো, তাই কষ্টও পেতো বেশী। খুব পরিশ্রমী, ল্যাব এক্টিভিটিসের লিডার। প্রফেসরের অনেক গন্জনা তাই তাকে সইতে হয়। কেউ ল্যাব মিটিং এ প্রেজেন্ট করতে না চাইলে কৃষ্ণা চেষ্টা করতো তাকে বাচাতে। অনেক সাফল্য আর ভালো আইডিয়া থাকা স্বত্বেও প্রফেসরের গোয়ার্তুমির কারনে আজও ভালো একটা পাবলিকেশন হয় নি। তার যে কাজ আছে, রেজাল্ট আছে, তাতে এখনই গ্রাজুয়েশন পেতে পারে, তবে রেনা সিনিয়র বলে তাকে দেয়া হচ্ছে না। ঠোটকাটা লোক বলে প্রফেসর-ইসমাইল-হোসাঙ-প্রকাশ কেউই পছন্দ করতো না তাকে। ল্যাব মিটিং এ অনেক বার প্রফেসরকে উচিত জবাব দিয়ে গোয়ার উপাধী পেয়েছে। বয়স হয়েছে ৩৫, তাই গ্রাজুয়েশনের নামে ব্ল্যাকমেইলিং করে প্রফেসর তাকে দিয়ে বিদেশী স্টুডেন্ট পটায়, তাই সে করেছে আমার ক্ষেত্রে। স্ত্রী কিরন আর মেয়ে স্নেহাকে নিয়া সংসার ছিল। কিরন ল্যাবেই স্টাফ হিসেবে কাজ করতো। ৪ বছরের বেশী হয়ে যাচ্ছে, সেও আশা করছে সামনের সিমেষ্টারে গ্রাজুয়েশন পাবে।

অল্তানযায়া টভুঃ যায়া নামেই পরিচিত। মংগোলিয়ান স্টুডেন্ট। বয়সে ৩২-৩৩ হবে। ভালো মেয়ে, রিসার্চেও ভালো, তবে অতোটা মেধাবী না। ডঃ ইসমাইলের সব রিসার্চে সে আছে, কিছু না বুঝলেও তার ডিগ্রী হয়ে যাবে বলে সবার বিশ্বাস। তবে ইংলিশে এত দুর্বল যে কথা বলতে গেলে সেটা উভয় পক্ষের জন্যই অত্যাচার হয়ে যেতো। বাচ্চা দেশে রেখে স্বামীকে নিয়ে কোরিয়ায় আছে। স্বামী এদিক ওদিক কাজ করে। রাশান পারে, তাই নানা ব্যাপারে রেনার হেল্প নিতো সবসময়। আড়াই বছর হয়ে গেছে তার ল্যাবে।

ডগসম বলোরামাঃ বলোরামা বলেই পরিচিত। মংগোলিয়ান এবং সব কিছু যায়ার মতই। শুধু সে বিবাহিতা না, এবং ভালো মেয়ে বা ভালো রিসার্চারও না, নারিকেল মাথা। সারাদিন সাজগোজ আর কুটনামীতে ব্যস্ত। ইংলিশে যায়ার চেয়ে কিছুটা ভালো। চেংগিস খানের বংশধর হিসেবে দাবী করা এই মহিলা ফাকিবাজিতে ওস্তাদ। সকালে প্রফেসর ল্যাবে আসা মাত্রই একটা বিকার বা কনিকেল ফ্লাস্ক নিয়ে বেসিনে গিয়ে ধোয়া শুরু করবে, যেনো অনেক সকাল থেকেই কাজ করে এখন ধুয়ে রাখছে। ল্যাবে আসবে সকাল ৮.১৫ এর দিকে, শীটে লেখবে ৭.৩০টা। তার এই আকামের সংগী যায়া। এজন্য ইসপেশাল ইনসেনটিভও পেতো, তবে স্বীকার করতো না। সব সময় গায়ে হাত দিয়ে কথা বলবে, হাত ধরে টানবে, এজন্য সবার ঝাড়ি খায়, একদিন আমি রেগে বাংলায় বলে উঠেছিলাম “ঐ গেলি”, তাও শোধরাবার কোন লক্ষন ছিলো না। ডঃ প্রকাশের দাবি, সে প্রফেসরের সাথেও এমন করে। ডঃ ইসমাইল পারলে এই মেয়েকে সব তুলে খাওয়াতো। একে নিয়ে আমরা হাসাহাসিই বেশি করতাম। এতে খেপতোও বেশি। যায়া আর সে একি সাথে কোর্স শুরু করেছে।


নটারান্জান ভালারমাথিঃ
ল্যাবের সবচে জুনিয়র পিএইচডি স্টুডেন্ট, ইন্ডিয়ান তামিল। আমরা একসাথেই শুরু করেছিলাম। ওর স্বামী ওখানেই আর এক ল্যাবে পোষ্টডক করতো, নিউলি ম্যারেড তখন। খুব ভালো মেয়ে, ভালো রিসার্চার। আমার বন্ধুর মত, ছোট বোনের মত। চুপচাপ নরম একটা মেয়ে আসার ৫-৬ মাস পরেই ঠোটকাটা-স্টাবোর্ন হয়ে গেলো। স্বামীর সাথে আলাদা বাসায় থাকলেও প্রফেসর ওর স্যালারি থেকে ডরম ভাড়া হিসেবে ১০০ ডলার কাটতো। সে এটার ক্লিয়ার করতে বলায় প্রফেসর সব দোষ কৃষ্ণার উপর দিয়ে ছিলো, অর্থ্যাৎ কৃষ্ণা নাকি ভুলে এটা ক্লিয়ার করে নি। ইয়াংজের কাছ থেকে ভালো কাজ শিখেছে, তাই প্রফেসরকে ও এখন আর তেমন পাত্তা দেয় না। এখনও আছে, কোর্স শেষ, রিসেন্টলি স্কলারশিপ পেয়েছে, তাই প্রফেসরের নিয়ন্ত্রন হতে মুক্ত। গ্রাজুয়েশনের ব্যাপারে সিরিয়াস না, স্বামী অন্য কোথাও চলে গেলে সেও চলে যাবে, এটাই তার ডিসিশন।

স্টাফঃ

মিসেস চোঃ প্রফেসরের সেক্রেটারী। ল্যাব টেকনিশিয়ান থেকে প্রমোশন পেয়ে এতদুর। ভালো মহিলা, তবে ইংলিশ এক বর্নও বুঝতে পারে কিনা সন্দেহ। আমি তাই তার সাথে বাংলায় কথা বলতাম, কারন সে ইংলিশ বুঝে না, আমি কোরিয়ান বুঝতাম না। তাই বাংলা আর ইশারাতে কথা হতো। হোসাঙ যদি প্রফেসরের ডানহাত-বামহাত হয়, মিসেস চো তবে তার অজুহাত। কারন সে ইংলিশ বুঝে না এই অজুহাতে ধরা পড়া সকল “ইচ্ছাকৃত ভুল”কে না বোঝার ভুল হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলতো। এখনও আছেন।


মিঃ সোঃ
সবার কাছে সিল চা নিম নামে পরিচিত হতে আগ্রহী, অর্থ্যাৎ নেতা। সে গ্লাসহাউসের কেয়ারটেকার, সাথে ল্যাবের বিভিন্ন মেরামতের কাজেও সে আছে। আগে ইউনিতেই কাজ করতো, অবসরের পর এই কাজে এসেছে। বুড়ো হলেও মনটা ইয়াং। এখনও ইন্টারনেট এর মাধ্যমে ইয়াং মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ওদের নিয়ে ডিনারেও যায়….., যদিও বিবাহিত, বউ জীবিত। ইংলিশ শেখার প্রানান্তকর চেষ্টা এই ৬০ এর বেশী বয়সেও, আমরা ছিলাম তার ইংলিশ শিক্ষক, সে ছিলো আমাদের কোরিয়ান ভাষার শিক্ষক। মনটা ভালো খুব, হাসিখুশি, দেখলেই বলবে চলো কফি খাই। আর আমাকে সব সময় বুদ্ধি দিতো বউকে আনার দরকার নেই, এখানেই একটা গার্লফ্রেন্ড জোগাড় করে সময়টা কাটাও, পরে দেশে ফিরে যেয়ো। প্রফেসরের একজন ইনফরমার ছিলো সে। গ্লাস-হাউসের গাছ-পালার যত্ন নিতো কম, অনেক সময় গাছে প্রসাব করে সারের ব্যবস্থা করতো। এখনও আছে।

হিয়োঙঃ ল্যাব অফিস স্টাফ। এই ল্যাব থেকেই মাষ্টার্স করেছে। ছেলে খুব ভালো , হেল্পফুল, আড্ডাবাজ, তবে সুজাতা দিদির স্যালারির টাকা মেরে দেয়ার জন্য এই ছেলেটার একাউন্ট নম্বর ব্যবহার করা হয়েছিলো। যদিও তার দোষ ছিলোনা বলেই জানি, সব প্রফেসরের বুদ্ধি। আমি থাকতেই অন্য চাকরী পেয়ে চলে গেছে।


কিরণঃ
কৃষ্ণার স্ত্রী, ল্যাবের টেকনিক্যাল স্টাফ। কমার্স গ্রাজুয়েট হলেও মলিকুলার বায়োলজি ল্যাবের ল্যাব টেকনিক-ইক্যুপমেন্ট গুলো সহজেই আয়ত্ত এনে ফেলেছিলো। তাই ল্যাবের অপরিহার্য হ্যান্ড ছিলো। খুব নরমাল, টিপিক্যাল একজন মহিলা, ভালোবাসা-হিংসা-বিদ্বেষ সব নিয়েই। আমি লাকি আমি তার ভালটাই পেয়েছি। খুব হেল্পফুল। এখন নেপালে ফিরে গেছে। এক মেয়ের পর এবার একটা ছেলে হয়েছে।

লায়লা খানমঃ ডঃ ইসমাইলের স্ত্রী। আরেকজন ল্যাব টেকনিক্যাল স্টাফ। মুল দায়িত্ব ছিলো ব্যবহৃত গ্লাস-ওয়্যারগুলো ধোয়া আর চাহিদা মত গবেষনার জন্য প্রয়োজনীয় গাছপালা লাগানো। খুব সাদাসিধা মহিলা। রেনাই একমাত্র বন্ধু তার। এখনও আছে।

অনেক বড় হয়ে গেলো। সরি…

পরের পর্বঃ আমার কোর্স এন্ড রিসার্চ এক্টিভিটিস-তিক্ততার নতুন পর্ব শুরু

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-৫)

ল্যাব রুল ও ল্যাব ম্যানেজমেন্ট

ডরমেটরীর কথা তো বলা হলো, এবার ল্যাবে যাই।

ঠান্ডায় শক্ত হয়ে যাওয়া ব্রেড আর দুধ গিলে রওনা দিলাম ল্যাবের দিকে কৃষ্ণার সাথে। সকাল ৮.৩০টার মধ্যে পৌছাতে হবে, কারন এটা ল্যাব রুল! প্রথম দিনেই আজারবাইজানী ল্যাবমেট আর কৃষ্ণা বলে দিয়েছিলো অনেক ল্যাব রুলের কথা। পরে আরো জেনেছি। অনেক রুল………। সেগুলো নীচে তুলে ধরছি।

ল্যাব রুল
১। সকাল ৮.৩০টার মধ্যে আসতে হবে, এবং ফ্রীজের সাথে ঝুলানো সীটে যার যার নামের পাশে বার অনুযায়ী আসার সময় লেখতে হবে।
২। প্রতি সোমবার প্রফেসর এর সাথে আলোচনা করতে হবে রিসার্চ নিয়ে। একটা বোর্ডে চলতি গবেষনার অগ্রগতি নোট করে আলোচনা করতে হবে। .
৩। প্রতি সপ্তাহের একটা করে ল্যাব মিটিং হবে। মিটিং এ সব মেম্বারকেই কিছু না কিছু করতে হবে। কেউ রিসার্চ পেপার প্রেজেন্ট করবে, কেউ বা নিজের রিসার্চ, কেউবা ল্যাবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জানাবে। এটার একটা সিডিউল ও আছে।
৪। প্রতি মাসে সবাইকে রিপোর্ট জমা দিতে হবে।
৫। ল্যাবের নতুন মেম্বাররা ল্যাব ধোয়া-মোছার কাজ করবে। প্রতিদিন।
এছাড়া আরও অনেক ছোট-খাটো নিয়ম আছে। ইস্যু ভিত্তিক। প্রসংগ এলে বলবো।

রুল গুলো শুনতে খুব ভালো লাগে। মনে হয় ল্যাবটা খুব অর্গানাইজড। আমারো তাই মনে হয়েছিলো। বিশেষ করে যে ভাবে প্রথমে বলা হয়েছিলো। এবার দেখি এসব রুলে কি সমস্যা ছিলো, আর রুল গুলো না মানলেই বা কি হতো?

সকাল ৮.৩০টার মধ্যে না আসতে পারলে রেকর্ড থাকতো, এবং এরকম ঘটনা ৩/৪ বার ঘটলে মাসিক স্যালারী কাটা হতো। ল্যাবের সিনিয়র মেম্বারদের এর তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেক আছে। আবার সব সময় খুব আর্লি আসতে পারলে ৫০ ডলার ইনসেনটিভ দেয়ার কথা ছিলো। শোনা যায় মংগোলিয়ান মেয়ে দুটা নাকি এটা পেতো। যদিও তারা অস্বীকার করতো। ওরা আসতো ৮.১৫ এর দিকে, টাইমশীটে লেখতো ৭.৩০টা। এটা আমাদের জন্য ছিলো একটা ডেইলী বিনোদন। আর এত কড়া নিয়মের কারনে সকাল সকাল সবাই এসে একটু পর বেরিয়ে গিয়ে ফাকি মারতো। প্রফেসর জিজ্ঞেস করলে বাধা উত্তর “গ্লাস হাউজে গেছে”।

প্রতি সোমবার প্রফেসরের সাথে রিসার্চ নিয়ে আলোচনা হবে। খুব ভালো শোনায়। কিন্তু আলাপটা একতরফা। “ইউ শুড নো..ইউ ডোন্ট নো….গারবেজ আইডিয়া…. ডোন্ট এক্সপেক্ট এনিথিং ফ্রম মি….ইউ হ্যাভ টু থিংক…. থিংক, থিংক….ডোন্ট জাস্ট থিংক….ডু সামথিং……ট্রাই টু কনট্রিবিউট সামথিং ইন ল্যাব…. মেক মি ফ্যামাস…..”। কেউ ডিসকাশনে গেলে প্রফেসরের রুম থেকে এসব ডায়ালগ ভেসে আসতো। আলোচনার জন্য যাওয়ার আগে স্টুডেন্টের চেহারা থাকতো ভয়ার্ত। আর ফিরে আসার পর অপমানে লাল। তারপর যে যার ভাষায় গালাগালি চালাতো। তার জন্য কারও মনে সম্মান দেখি নি। যারা পাশ করে গেছে, তাদেরও না, যারা ল্যাবে আছে, তাদেরও না। কারন ঐ ইউনিভারসিটির কুখ্যাত তিনজন প্রফেসরের একজন তিনি, যাদের বিরুদ্ধে ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছে। ল্যাব মেম্বারদের মুখে মুখে বুলি ছিলো “ডু সামথিং”। এখনও ওদের অনলাইনে চ্যাট হলে এই কথাটা চলে আসে। আর হ্যা, রিসার্চ ডিসকাশনে না গেলেও স্যালারী কর্তন।

প্রতি সপ্তাহে ল্যাব মিটিং হবে। আমি যখন যাই তখন ফিক্সড ছিলো সোমবার সন্ধ্যা। ক্লাশ শুরু হবার পর সোমবার সন্ধ্যায় ক্লাশ থাকায় মিটিং গেলো শুক্রবারে। কৃষ্ণা ল্যাব এক্টিভিটিস এর লিডার। তাই তার কাছে প্রফেসরের ওহী আসতো, কৃষ্ণা সবাইকে ইমেইলে জানিয়ে দিতো সেই বানী, কয়টায় হবে মিটিং, সিডিউল অনুযায়ী কে কি প্রেজেন্ট করবে। সবারই ছিলো ল্যাব মিটিং নিয়ে ভীতি। পারলে কোন রিসার্চের অজুহাতে ফাকি দিতো। কারন মিটিং এ সবার সামনেই প্রফেসর ফাউল কথা বলে অপমান করতো। এবং একজনকে দিয়ে আরেকজনকে অপমান। যাতে মেম্বারদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ থাকে। কোন পাবলিশড পেপের প্রেজেন্ট করলে বলতো, হোয়াট ইজ নিউ? কৃষ্ণা একবার খেপে বলেছিলো, পাবলিশ তো হয়ে গেছে, নতুন কি পাবে। সে মুখ লাল করে কৃষ্ণাকে স্টাবোর্ন বলে গালি দিয়েছিলো। সবচে খারাপ অবস্থা হতো রিসার্চ প্রেজেন্টেশনে। যেমন প্রফেসর, তেমন তার স্টুডেন্টরা। রিসার্চের কোথায় কি ভুল, কি করা হয় নি, সবার এসব নেতিবাচক কথা-বার্তায় ভরে উঠতো রুমটা। ভয়ে কেউই প্রেজেন্ট করতে চাইতো না। সবচে শান্তি ছিলো ল্যাবে যার যার দায়িত্ব সম্পর্কে জানানো। একটা বলে দিলেই হলো, একি কুমিরের বাচ্চা বার বার। আমার দায়িত্ব ছিলো কম্প্যুটার। কয়টি, কিভাবে, কোন কাজে আছে তার রিপোর্ট দেয়া। এখানেও উপস্থিত না থাকা বা প্রেজেন্ট না করার শাস্তি স্যালারী কর্তন।

মান্থলি রিপোর্ট জমা দিতে হবে। অর্থ্যাৎ আগের মাসে কি করা হয়েছে। রিপোর্ট পেলেই স্যালারী হতো। না হলে না।

ল্যাবের নতুন মেম্বাররা ল্যাবের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে থাকবে। কেউ ফাকি দিলে, এবং রিপোর্ট হলে স্যালারী কর্তন।

মোট কথা এত কড়া নিয়ম আর স্যালারী কাটার হুমকীর কারনে সবাই ছিলো অসুখি। কথায় কথায় স্যালারী কাটার খোটা। আমাকে ২য় দিনেই বলা হলো, এসব না করলে তোমার স্যালারী কেটে নেবো। বল্লো স্বয়ং প্রফেসর। স্টুডেন্টরা ওখানে স্লেভ এর মতই ছিলো।

ল্যাব ম্যানেজমেন্ট
ল্যাব ম্যানেজমেন্ট মানে বলতে চাচ্ছি ল্যাব চালাতে প্রফেসরের স্ট্রাটেজি কি ছিলো।
ল্যাবের মুল ফান্ডিং হতো বিভিন্ন রিসার্চ প্রজেক্ট হতে। অনেক গুলো রিসার্চ প্রজেক্ট ছিলো, কয়েকটা ছিলো অনেক দীর্ঘমেয়াদী, বাজেটও ছিলো অনেক। বড় বড় রিসার্চ প্রজেক্টগুলোর ফান্ডিং হতো ব্রেইন কোরিয়া-২১(বিকে-২১) নামক প্রোগ্রাম দিয়ে। বিভিন্ন প্রজেক্টে এক একজন স্টুডেন্ট রিসার্চার হিসেবে থাকতো। প্রফেসর বিকে-২১ এর লোকাল হেড। তাই এক কুমির বারবার দেখানোতে প্রবলেম হতো না। অর্থ্যাৎ একি স্টুডেন্টকে কয়েকটা প্রজেক্টে দেখানো।

বিকে-২১ থেকে একজন স্টুডেন্ট পেতো ৯০০ ডলার। কোর্স সিমেস্টারে মাসিক ২৫০ ডলার টিউশন ফি দিলে হাতে আসার কথা ৬৫০ ডলার। যাদের নিজের একাউন্টে এই টাকাটা আসতো তারা এই ২৫০ডলার উঠিয়ে দিয়ে দিতো ল্যাব অফিসে, আর তার সাথে উপরি হিসেবে আরো ১৫০ ডলার দিয়ে দিতে হতো। প্রফেসারের নির্দেশে নিজের স্যালারি থেকে ১৫০ডলার দিয়ে দেয়া কে উপরি বলবো নাতো আর কি বলবো। আরো ১০০ ডরমেটরির চার্জ। চলতে হতো ৪০০ ডলারে।

কোর্স সিমেস্টার শেষ হয়ে গেলে টিউশন ফি লাগতো না, তখন ল্যাবকে কত দিতে হতো বলুন তো? ১৫০ ডলার? হলো না, পুরো ৪০০ (২৫০+১৫০) ডলার, ডরমেটরি চার্জ ছাড়া। এতটাই জোচ্চর ছিলো ওরা। আমরা যারা জুনিয়র ছিলাম, তাদের টাকাটা কায়দা করে ল্যাব একাউন্টে আনা হতো, আর আমাদের একাউন্টে সরাসরি ৪০০ দেয়া হতো (ডরমেটরির জন্য ১০০ কেটে)। যাওয়ার পরপরই চুক্তিপত্রে সাইন করতে হতো, সব কোরিয়ান ভাষায়, বুঝার কোন উপায় নেই। জিজ্ঞেস করলে বলে, এমনি ফরমালিটি। আসলে চুক্তি অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ করার কথা। সেটা লুকানো হতো। আমি জেনেছি আরো পরে নিজে পড়তে জানার পর, অন্যদের সাথে কথা বলার পর।

ভাষার জন্য বিদেশী স্টুডেন্টরা কিছু বুঝতো না। আবার ৩য় বিশ্বের কোন দেশ থেকে এলে কোরিয়ান গভর্মেন্ট হতে তখন ছাত্র প্রতি স্পেশাল গ্র্যান্ট আসতো, সেটাও জানা যেতো না। এছাড়া ছোট-খাটো এককালীন কিছু স্কলারশীপ ছিলো, বই-স্টেশনারী বা গবেষনার জন্য ছোট-খাটো খরচের জন্য। এগুলো সব প্রফেসর আর তার কোরিয়ান ছাত্র-অফিসাররা দেখভাল করত, আমাদের পক্ষে অ্যাপ্লাই করতো। টাকাটা আমাদের একাউন্টে এককালীন চলে আসতো আর আমরা শুধু কয়েকমাস পর পর নিজেদের একাউন্ট হতে হঠাৎ ভুলে চলে আসা কয়েকশ হতে হাজার ডলার প্রফেসরের কথা মতো উঠিয়ে দিতাম। এই জন্য ভুলে চলে আসা বল্লাম, কারন আমাদের বলা হতো “তোমার একাউন্টে ভুলে কিছু টাকা চলে গেছে, উঠিয়ে দিয়ে দাও”। সবারই একি অভিজ্ঞতা। মজার ব্যাপার হলো টাকাটা হাতে হাতে চায় তারা, ব্যাংক ট্রান্সফার করতে রাজী না, কারন তাতে রেকর্ড থাকবে, স্টুডেন্টরা চাইলেই অভিযোগ করতে পারবে এই দুই নম্বরীর। আমি এই নিয়ে মজা করতাম, জোর করে বলতাম ট্রান্সফার করি, সমস্যা কি? ওরা খেপতো খুব। আর এটা এড়াতে ইয়াংজেকে দিয়ে আমাকে বলাতো, কারন ওর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো।

আবার দেশের মধ্যে বিভিন্ন কনফারেন্স-সেমিনারে যাওয়ার জন্য বিকে-২১ এর ফেলোশীপ হোল্ডারদের ১০০-৩০০ ডলার দেয়া হতো। এটা কখনই আমরা পাই নি। শুধু মাঝে মাঝে কোরিয়ান টাইপ করা কাগজে সাইন করতাম। ইয়াংজে কে জিজ্ঞেস করলে হেসে বলতো ঐ একটা কনফারেন্স এর টাকা, বাদ দাও।

এই সব কারনে বিদেশী ছাত্র আর রিসার্চররা প্রফেসরের খুব প্রিয় ছিলো। ম্যানিপুলেশন বেশি করা যায়, নিরাপদ।

ততদিনে প্রফেসরের একটা নামও দিয়ে দিয়েছি আমি আর কৃষ্ণা মিলে। “বুড্ডা”। আরো অনেক নাম প্রস্তাব করা হয়েছিলো, কিন্তু এটা সিলেক্ট করার কারন হলো প্রফেসর কিছু হলেই গুগল সার্চ দেয়, আর বুড্ডা সার্চ দিলে গৌতম বুদ্ধই আসবে রেজাল্টে। সো ধরা পড়লেও আমরা সেইফ।

পরের পর্বঃ ল্যাব মেম্বারদের পরিচিতি

Thursday, December 18, 2008

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-৪)

এখন থেকে দিনপঞ্জীর মত ধারাবাহিকভাবে ঘটনা গুলো আর বলবো না, একেকটা বিষয় নিয়ে বলে শেষ করে যাবো। না হলে অনেক পর্ব হয়ে যাবে, ঝুলেও যাবে। আজ বলবো শুধু ডরমেটরী নিয়ে।

ডরমেটরী ব্যবসা

প্রথম রাতটা ভালোই ঘুম হলো, উঠে গেলাম সকাল সকাল, ৬.০০টার দিকে। অভ্যেস ছোটবেলার। মনে হলো ল্যাবে যাওয়ার আগে বাসাটা একটু দেখে নেই। প্রচন্ড ঠান্ডা রুমে, মোটাসোটা কিছু কাপড় চাপিয়ে রুম থেকে বের হলাম ল্যাবের ডরমেটরী দেখতে। এবার তাহলে ডরমেটরী নিয়ে ডিটেইলস বলিঃ

আমি নীচ তলায়, এখানে তখন ৩টা বেড রুম। আছে আরো দুইটা তবে একটা কিচেন বানানো হয়েছে, আরেকটা ষ্টোর-মানে যার যা এক্সট্রা তা ফেলে রাখে। আমি ছাড়া আপাতত একজন শুধু নীচ তলায় থাকতো, নাম ইয়াংতে। ঐ সময় সে জাপানে ছিলো, তাই দেখা হয় নি। খুব ভালো ছেলে। উপরের তলায় কৃষ্ণা তার ফ্যামিলি নিয়ে (বউ আর বাচ্চা), আর তিনজন মেয়ে, ল্যাবের পিএইচডি স্টুডেন্ট।

কিচেন বলতে আলাদা কিছু না, রুমটাতে একটা গ্যাসের ওভেন, একটা মাইক্রোওয়েভ আর একটা ফ্রিজ। সব ইয়াংতের। অন্যদের ব্যবহার করতে দেয়। কোন সিন্ক বা ধোয়াধুয়ির ব্যবস্থা নেই, কারন পানির একমাত্র সোর্স হলো বাথরুম। কমন স্পেসে একটা টিভি আছে, ওটাও ইয়াংতের। বাথরুমটা মাঝারী সাইজের, তবে ইয়াংতের ওয়াশিং মেশিনটা বিশাল জায়গা নিয়ে নিয়েছে। ওটা থাকায় বাচোয়া, ডরমের সবাই কাপড় ধোয়ার কাজটা সহজে করতে পারে। গরম পানির ব্যবস্থা গ্যাস হিটার দিয়ে।

কয়েকদিন ওখানে থেকে ডরমেটরী কেন্দ্রিক ব্যবসাটা টের পেলাম। ডরম ল্যাব থেকে কিছুটা দুরেই, এক পাহাড়ের ঢালে। ওখান থেকে নেমে আরেক পাহাড়ে উঠে তবেই ল্যাব। সময় লাগতো ১৫ মিনিট, তবে প্রচুর পরিশ্রমের, পা ব্যাথা হয়ে যেতো। আমার জুতো ঐ পাত্থরে রাস্তায় ক্ষয় হয়ে গেলো কয়েক মাসেই। ওজনও কমে গিয়েছিলো ৭ কেজি প্রথম এক মাসেই। এত দুরে ডরম নেয়ার কারন কি? আছে, পরে বলছি।

কোরিয়ায় যারা ছিলেন বা আছেন তারা জানেন সেখানকার বর্তমানের এ্যাপার্টমেন্ট কালচার। সব ছোট-খাটো সব বাড়ি ভেংগে বহুতল বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। এজন্য সেসব বাড়ির মালিকদের ক্ষতিপুরন দেয়া হয়। বাড়িটা ব্যবহৃত অবস্থায় ভাংগার জন্য নিলে টাকা বেশী।

আমরা যে বিল্ডিংটাই থাকতাম সেটা আগে রেস্টুরেন্ট ছিলো, ভারসিটিরই এক শিক্ষকের বাড়ী। এই এলাকাটাও ভেংগে বহুতল এ্যাপার্টমেন্ট হবে, তাই ভাড়াটিয়ারা আগেই ঝামেলা চুকিয়ে চলে গেছে। নিজের বাড়ি হলেই কেউ থাকছে, না হলে না। আর কেউ না থাকলে ক্ষতিপুরন কম পাবে নিদ্ধিধায়। এখানেই চুক্তি হলো আমার আর ঐ প্রফেসর এর। আমার প্রফেসর ঐ বাড়িটা ভাড়া নিলো একবারে কিছু বন্ড হিসেবে দিয়ে, তবে মাসিক ভাড়া দিতে হবে না, আর চুক্তি শেষে বন্ডটা ফেরত পাবে। বাড়িওয়ালা তাতেই খুশী কারন সে ক্ষতিপুরন বেশি পাবে আর বন্ডের টাকাটা আপাতত কোথাও ইনভেস্ট করতে পারবে। এটা কোরিয়ায় কমন একটা প্র্যাকটিস, বেশি বন্ড দিলে অনেকসময় ভাড়াই দিতে হয় না, বরং শেষে পুরো বন্ড ফেরত পাওয়া যায়। লাভ দুইজনেরই।

এই বাড়িটাই সে ব্যবহার করছে ল্যাব ডরমেটরি হিসেবে। বর্ডার একেবারে বাধা, তার স্টুডেন্টরা। তাদের কাছ থেকে এস্টাবলিশমেন্ট কস্ট নেয় ১০০ ডলার, মাসিক ভাড়া ১০০ ডলার মানুষ প্রতি। কেউ ফ্যামিলি নিয়ে থাকলে ফ্যামিলি মেম্বারদেরও ধরতে হবে আলাদা ভাবে। গ্যাস-বিদ্যুত-পানির বিল যা আসবে সবাই মিলে দিতে হবে। কৃষ্ণা বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকতো তাই বউয়ের জন্য আলাদা ভাড়া দিতে হতো, বাচ্চাটার জন্যও নিতে চেয়েছিলো, কৃষ্ণা অনঢ় থাকায় পারে নি।

মাসিক ভাড়া তাই প্রতি জনে ১০০ডলার, সাথে বিদ্যুত্-পানির বিল। যেহেতু এ দুটি ইউটিলিটির একাউন্ট পারসোনাল বা ফ্যামিলি ইউজার হিসেবে করা তাই ডরমে থাকা সাতজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের বিদ্যুত-পানির ব্যবহার সব-সময়ই একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতো, বিল হয়ে যেতো ডবল রেটে। অতিরিক্ত ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য এই ডবল রেটের নিয়ম। ফলাফল, বিল আসতো অনেক বেশী। প্রতি মাসে ১০০ ডলার ভাড়ার সাথে ২৫-৪০ ডলারের ইন্ডিভিয্যুয়াল বিল আসতো। এই টাকায় অন্য কোথাও কারো সাথে শেয়ারে থাকা যেতো ভালো ভাবেই।

ডরমেটরী এত দুরে নেয়ার কারন তাই সহজচুক্তিতে বাড়ি পাওয়া, কম টাকায় দফারফা, বাধা ভাড়াটিয়া। আরো আছে, যেমনঃ

# এত দুরে বাসা হওয়ায় কেউ খুব বেশি বার ল্যাব-বাসা করবে না। তাই ল্যাবে একবার এলে সহজে বাসায় যাবে না। যাবে একেবারে রাতে। তাহলে কাজ বেশি করবে।
#এত ঠান্ডাতেও হিটার ঠিক করা হয় না, কারন সবাই তাই এত তীব্র শীতে বাসায় কম সময়ই কাটাবে।

এগুলো আমার বানানো না, ল্যাবের সিনিয়র ষ্টুডেন্টদেরই কথা। কারন এর চেয়ে কাছে বাসা পেলেও নেয় নি সে।

কয়েকদিনেই ঠান্ডায় কাহিল হয়ে, আর বাসার এই দুরত্ব-সংগীন অবস্থা দেখে ঠিক করলাম আলাদা থাকবো। ভারসিটির ডরমেটরীতে থাকলে শুধু ১০০ ডলার দিলেই হয়, কিন্তু খাওয়া-দাওয়া সমস্যা। বাইরে খেতে হয়। একটু বেশি চার্জ পড়ে। সবচে ভালো দেশী কারও সাথে, না হলে প্রতিবেশী দেশের ছাত্রদের সাথে শেয়ার করে থাকা। কৃষ্ণার সাথে আলাপ করলাম। সে হাসে আর বলে এখনও বুঝো নাই……। আমি বারবার চেপে ধরায় বল্লো আমাকে ডরম ছাড়ার অনুমতি দেয়া হবে না। মগের মুল্লুক নাকি! আমি ক্ষেপে গিয়ে বল্লাম, কেনো? কিভাবে আটকে রাখবে?

আটকে রাখার পদ্ধতি খুব সহজ। ১০০ ডলার বাসা ভাড়া কেটে রেখে আমাকে দেয়া হচ্ছে ৪০০ ডলার, আমি ঐ বাসায় না থাকতে চাইলেও এই ১০০ ডলার ওরা কেটে রাখবে। এটা ল্যাব রুল! ল্যাবের সব স্টুডেন্টরা দিতে বাধ্য। আর ৪০০ ডলার দিয়ে বাসা ভাড়া করে-খেয়ে দেয়ে বাচা খুব কষ্টকর। সো আমি বাধ্য, সবাই এভাবেই বাধ্য! অক্ষম রাগে মাথার চুল ছিড়ি। আমি মুল স্কলারশিপ পাবার আগে তখন প্রজেক্টে রিসার্চার হিসেবে ছিলাম। তাই সব নিয়ন্ত্রন প্রফেসরের হাতেই। কৃষ্ণা সহ বাকি ল্যাবমেট যারা ঐ বাসায় থাকতো, সবারই একই অবস্থা। রিসার্চার হিসেবে ঘানির বলদের মত চলা। নিজেরা গুজগুজ-ফুসফুস, আর প্রফেসরের সামনে অতি বাধ্য। স্যালারীর নিয়ন্ত্রন যে তারই হাতে।

মুল মালিককে কোন ভাড়া দিতে হয় না, বাধা ভাড়াটিয়ারা বিনাবাক্যব্যায়ে সব মেনে নেয়, এস্টাবলিষ্টমেন্ট চার্জটা তো উপরি। এক্সট্রা ইনকাম। কি অসাধারন ব্যবসা। টাকা যা দেয়, ঘুরে ফিরে নিজে নিয়ে নেয়।

মনের মধ্যে একটা জেদ তৈরি হয়েছিলো। এভাবে ঘাড় গোঁজ করে বাচা যায়? একেবারে কিছু না বলে মেনে নেবো? কি করা যায়?

যখন বুঝতে পারলাম ঐ হিম-নরকে থাকতেই হবে নিজের স্কলারশীপ না পাওয়া পর্যন্ত, তখন এস্টাবলিসমেন্ট চার্জটাকে কাজের লাগানোর বুদ্ধি মাথায় এলো। আসার কয়েকদিন পর একদিন সোজা প্রফেসরের রুমে গিয়ে বল্লাম, আমার খুব ঠান্ডা লাগছে বাসায়, কোন হিটার নেই, আমার জন্য একটা গ্যাস হিটার কেনা হোক। এস্টাবলিসমেন্ট চার্জটা তো এইকাজেই নিয়েছে। সে তো রাজি না, প্রথমে গাই-গুঁই করলো, আমিও নাছোড়বান্দা, আমাকে নিজে কিনে নিতে বলে, সবাই কিনেছে। আমিও ঐ চার্জটার যৌক্তিকতা বুঝাই। তখন নতুন নতুন, সবার মত ভয়-ডর পাই না। একসময় বিরস মুখে মানতে বাধ্য হলো সে। তার সেক্রেটারীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ইয়াংজে কে অনুরোধ করে (গাড়ীর জন্য) কৃষ্ণা সহ গিয়ে কিনে আনলাম। আমার একটা বিজয়। কেনার পর ইয়াংজে হাসে, কৃষ্ণা গান গায় “তুমছে আচ্ছা কৌন হ্যায়……..” আর বলে, “ইতনে দিন তুম কাহা থে? গুরুকো তো বোল্ড আউট কার দিয়া।”

এই জেদটা শেষ পর্যন্ত ছিলো, ধাক্কা আর একটা দিতে পেরেছিলাম স্কলারশীপ পাবার পর। সময় মত তাও বলবো।

পরের পর্বঃ ল্যাব রুল ও ল্যাব ম্যানেজমেন্ট

Monday, December 15, 2008

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-৩)

হোয়াট এ ওয়েলকাম! এবং অতঃপর…..

বাস স্ট্যান্ড থেকে ইয়ানজের গাড়ীতে করে রওনা দিলাম ইউনিভারসিটির দিকে। লাগেজ গুলো খুব ভারী ছিলো, উঠাতে খুব কষ্ট হয়েছে, ঢাকার নিউমার্কেট থেকে কেনা স্যুটকেসটা বিমান থেকে পড়লেও ভাংগবে না গ্যারান্টি দেয়া হলেও কোরিয়ায় বাস থেকে নামতেই হ্যান্ডেল ভেংগে শেষ। তাই পাঁজাকোলে করে গাড়ীতে তুলতে হয়েছে।

পথে কৃষ্ণা আর ইয়ানজে মিলে ঠিক করলো আগে ল্যাবে না গিয়ে ডরমেটরীতে যাবে, আমার লাগেজ রেখে পরে ল্যাবে যাওয়া হবে। কোরিয়া মানেই পাহাড়, উচু নিচু রাস্তা পার হয়ে একটু উচুতে একটা রাস্তায় গাড়ীতে থামলো। একটা গলির ভেতরে দোতালা একটা বাড়ির সামনে লাগেজ টেনে-হিচড়ে নিয়ে গেলাম। দেখা গেলো চাবি নেই কারো কাছে? ক্লান্তির মধ্যে এমন দেখলে বিরক্তিই আসে। আপাতত বড় আর মাঝারি লাগেজ দুটা বাড়ির সামনের একটা এক্সট্রা রুমে রাখা হলো, কোন নিরপত্তা ছাড়াই। স্লাইডিং কাচের দরজা, তালা নেই। আমাকে অভয় দিলো কিছু হবে না। সমস্যা হয়নি অবশ্য।

এবার আবার প্যাচিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আবার উঠে পৌছালাম ইউনিভারসিটি। কাধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে তীব্র শীতটা ওভারকোটে ঢাকার চেষ্টা করতে করতে বহুতল একটা ভবনে ঢুকলাম ওদের সাথে। লিফটে ৫ নং ফ্লোরে উঠে ওদের পিছু পিছু গিয়ে ঢুকলাম ল্যাবে। বলা হলো প্রফেসর লি রুমে বসে আছেন, গিয়ে দেখা করে আসো।

ল্যাবের ভেতরেই তার আলাদা রুম। গেলাম। সম্ভাষন দিয়ে পরিচয় দিলাম। একটা শুকনা হাসি দিয়ে হাক দিয়ে উঠলো “কৃষ্ণা”। কৃষ্ণা পড়িমড়ি করে ছুটে এলো (দৃষ্টিকটু ভাবেই), প্রফেসর বল্লো “ওকে ডরমেটরী দেখিয়েছো?” হ্যা উত্তর পেয়ে আমার দিকে তাকালো, বল্লো, ল্যাব ডরমেটরীতে থাকতে ১০০ ডলার তো লাগবেই, সাথে এসটাবলিসমেন্ট কস্ট হিসেবে আরো ১০০ ডলার দিতে হবে। আর নেক্সট সোমবারে নিজের উপর একটা প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। আমি বিহবল!

মানসিক-শারীরিক ধকল আর এক্সপেকটেশনের আনেক্সপেকটেড অবস্থা দেখে আমি আসলেও বিহবল! শুধু বলতে পারলাম “ওকে!”। এই ওকে দিয়েই পরবর্তিতে অনেক ঝামেলা এড়িয়েছি। বাকী আলাপ পরে হবে আর ল্যাবমেটদের কাছ থেকে সব জেনে নিতে বলে সাক্ষাত পর্ব শেষ হলো।

বেলা তখন দুপুর ২.৩০-৩.০০টা। ক্ষুধাও লেগেছে। কোন সকালে বন্ধুর বাসা থেকে খেয়ে বের হয়েছি বাসের জন্য। ল্যাবে সবাই যেমন ব্যস্ত, বলার ইচ্ছে হলো না। আর মাথায় তখন ঘুরছে দুটো জিনিস। বাসায় ফোন করা আর বেড কিনা। নাইলে এই ঠান্ডায় ঘুমাবো কোথায়?

দু’একজন ল্যাব-মেটের সাথে পরিচয় হওয়া শুরু হলো। সবার ব্যাপারে বিস্তারিত বলবো পরের কোন পর্ব।

কৃষ্ণাকে বললাম একবার বেড কেনার কথা। সে বললো একটু পরই যাবে। এই একটু পর অবশেষে হলো সন্ধ্যা। আসলে কৃষ্ণার কিছু করার নেই। সে চেনেনা কোথা থেকে কিনতে হবে। কয়েকমাস আগে প্রকাশ নামে একজন ইন্ডিয়ান পোষ্টডক হিসেবে এসেছে, সে চেনে, সে নিয়ে যাবে। সন্ধ্যায় গেলাম একসাথে। সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসেরও যা দাম! তার মধ্যেই দামাদামি করে একটা কমপ্লিট বেড কিনলাম (খাট এর মত ফ্রেম, তার ভেতরে প্লাস্টিকের স্টেজ, আর মোটা গদি), ডবল সাইজড। ৬০ ডলার! ডেলিভারী দিয়ে গেলো বাসায় আরো ১০ডলারে। ঐ ট্রাকেই আমরা ডরমেটরীতে। এইবার খোলা হলো নীচতলা। আমার জন্য নির্ধারিত রুমে গেলাম, ময়লা একটা রুম। খাটটা পাতা হলো। আমার লাগেজ টেনে ভিতরে নিলাম।

রুমে প্রচন্ড ঠান্ডা! বন্ধুর বাসায় দেখেছি হিটার চলে ঠান্ডায়। তাই এখানেও হিটার আছে ধরে দেয়ালে থাকা হিটারের সুইচ দিলাম, কৃষ্ণা হেসে জানালো ঐ হিটার চলে না। অর্থ্যাৎ তেলের কেন্দ্রীয় হিটারটা নাকি গত বছর ব্রাস্ট হয়েছে, ঠিক করা হয় নি। এখন সবাই একটা করে গ্যাস হিটার চালায় যার যার রুমে, তবে অক্সিজেনের অভাবে বেশীক্ষন নাকি চলতে পারে না। আমি ভয় পেলাম, তখন মনে পড়লো বেড হিটার তো আছে আমার, তবে কোন ব্ল্যাংকেট নেই, ঠান্ডায় তো রাতে মরে যাবো। বেড হিটার দিয়ে নীচে গরম হবো উপরে তো হিম-ঠান্ডা, নাক-মুখ তো জমে যাবে! ব্ল্যাংকেট কিনতে হবে!

কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেলো, কৃষ্ণা রাতে নিয়ে যাবে কোন মার্কেটে ব্ল্যাংকেট কিনতে। ক্লান্তি পুরো শরীরে, তাও ঐ জন্য যেতেই হবে। কৃষ্ণা খুব হেল্পফুল আর সামাজিক একটা মানুষ, ধরে নিয়ে গেলো খাবারের জন্য। ওর বউ-বাচ্চার সাথে পরিচিত হলাম। ভাত-সব্জি টানলাম ভালোই। রান্না আমাদের মতই, একটু ধনিয়া আর পাঁচ-ফোড়ন বেশী দেয়। আর কারী-পাতা দেয়। চিনতাম না এই পাতা। সেদিনই চিনলাম।

কৃষ্ণার সাথে ল্যাবে গেলাম আবার রাত ৭.৩০টার দিকে। প্রফেসর ছাড়া সবাই আছে ল্যাবে! এটাই নাকি স্বাভাবিক, এবং থাকে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত! একটু অবাকই হলাম। শংকিতও! আমার দুঃশ্চিন্তা, মার্কেট তো বন্ধ হয়ে যাবে। কৃষ্ণা অভয় দেয়, পাওয়া যাবে। দু’চোখে ভীষন ক্লান্তি-ঘুম-দুঃশ্চিন্তা। এর মাঝে ফোন করে বাসার সবাইকে দুঃশ্চিন্তা মুক্ত করা। কৃষ্ণা খুব ব্যস্ত, সো ল্যাব থেকে বের হতে হতে রাত ১১টা। রাতে হোমপ্লাস (Homeplus) নামের কোরিয়ার এক চেইন-স্টোরে গিয়ে লেপ/ব্ল্যাংকেট কিনলাম, ৩০ ডলার। সাথে সকালের জন্য কিছু খাবার। হেটে ফিরলাম বাসায়, তখন রাত ১২.৩০।

প্রচন্ড ক্লান্তির মধ্যে বিছানা গুছিয়ে, বেড হিটার লাগিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে নিতেই ঠান্ডায় জমে শেষ। কারন ঘরে কোন হিটার নেই। তাপমাত্রা মাইনাস, দেশী আরামদায়ক শীতে অভ্যস্ত আমি কাপছি রিখটার স্কেলে ৮টার তীব্রতায়। দ্রুত লেপের নীচে ঢুকে গেলাম। হাত-পা ঘষতে ঘষতে চলে গেলাম ঘুমের রাজ্যে। পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে….

ও বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, ল্যাবে যেতে হবে সকাল ৮.৩০টার মধ্যে, এটাই নিয়ম, নাইলে খবর আছে……। কি খবর? পরের পর্বে বলছি।

পরের পর্বঃ ল্যাব রুল, ল্যাব ম্যানেজমেন্ট পলিসি, আর ডরমেটরী ব্যবসা।

(বেশী বড় হয়ে গেলো বলে এই পর্বে ডরমেটরীর আসল ভন্ডামির কাহিনী পুরা বলা হলো না, হবে নেক্সট পর্বে)

Friday, December 12, 2008

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-২)

প্রস্ততি, আরেক ভন্ডামী, খুশীর খবর এবং যাত্রা।

প্রথম পর্বে বলেছি আমার প্রস্তুতি শুরু হলো। মানে যা হয়, কেনাকাটা-ছুটি নেয়া-ভিসার জন্য কাগজ-পত্র রেডি করা। জানুয়ারীতে সেবার কুরবানীর ঈদ ছিলো, দ্বিগুন উৎসাহে ঈদের ছুটির আগেই শিক্ষা ছুটি নেয়া শেষ। বাকী শুধু ভিসা, ঈদের পরে করবো আবেদন।

এর মাঝে আর একটা ভন্ডামী করা হলো। আমি স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলাম একোমোডেশন সম্বন্ধে। পরামর্শের জন্য। আমাকে বলা হলো (কৃষ্ণা) আমি চাইলে ভার্সিটির ডরমেটরীতে থাকতে পারি, খরচ মাসে ১০০ ডলার, তবে রান্না করা যাবে না। আবার ল্যাব মেম্বারদের জন্য একটা ডরমেটরী আছে, ল্যাব থেকেই মেনটেইন করা হয়। ওখানেও ভাড়া মাসে ১০০ ডলার, রান্নাও করা যাবে। কোনটা বাছবো? স্বাভাবিক ভাবেই ল্যাব ডরমেটেরী। ল্যাবের আবার ডরমেটেরীও আছে, ভাবুন তো শুনতে কত আনন্দ লাগে? বলা হলো আমাকে শুধু বেড কিনতে হবে। বাকী সব আছে। আমিও খুশী হয়ে বলে দিলাম “আমার জন্য একটা সিট বুক করো!”। হাহাহা। এটাকে কেন ভন্ডামী বললাম তা বলবো পরে।

মনে তখন খুব আনন্দ! বাইরে যাওয়া হচ্ছে অবশেষে পিএইচডি করতে! যারা গেছেন তারা অনুভব করতে পারছেন হয়তো। এর মাঝে আর একটা বিশাল খুশীর খবর, ২০০৭ এর জানুয়ারীর ৯ তারিখে কনফার্ম হলাম যে আমার ওয়াইফ কনসিভ করেছে। আমি বাবা হতে যাচ্ছি। প্ল্যান আরও পাকা, গিয়েই নিয়ে যাবো, যত দ্রুত পারা যায়।

ঢাকা থেকে ব্যাংকক হয়ে বুসানে থাই এয়ারলাইন্সের একটা ফ্লাইট ছিলো, ট্রাভেল এজেন্টের ভুলে সেটা জানতে পারলাম না, আমি যাওয়ার পর অবশ্য সে আমার বাবাকে বলেছে তার ভুলের কথা। আমি ড্রাগন-ক্যাথে প্যাসিফিকে ইনচোন (Incheon) এয়ারপোর্ট (Seoul-এ) যাবো। আমার আগে যাওয়া বন্ধুটা পাশের সিটি “Suwon” এ থাকে, তার ওখানে এক রাত কাটিয়ে পরে লিমোজিন বাসে করে রওনা দেবো বুসানের উদ্দেশ্যে। বুসানে Nopodong Bus Terminal থেকে আমাকে নিতে আসবে কেউ ল্যাব থেকে। প্ল্যান ফাইনাল।

কোরিয়ান এমব্যাসিতে ভিসা নিতে অনেকের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, আমার তেমন কিছু না হলেও আমার পাসপোর্টটা আরেক জনকে দিয়ে দেয়া হয়েছিলো, সেই লোক এসে ফিরিয়ে দেয়ার বাঁচোয়া। তার পাসপোর্টটা আমাকে দিতে গিয়েই ধরা পড়েছিলো অবশ্য। যাহোক এটা ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার!

২০০৭ এর জানুয়ারীর ২১ তারিখ রাতে বাসার সবাইকে কাদিয়ে (আমি সবার ছোট), নিজের চোখ শুকনা রেখে রওনা দিলাম। মনের অবস্থা জটিল। প্রিয়জনদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট-বাইরে যাওয়ার আনন্দ-শংকা-ভয় মিলে এক জটিল মানসিক অবস্থায় আমি। হংকং পর্যন্ত অন্য বিভাগের এক সিনিয়র কলিগের আড্ডা মেরে ভালোই গেলো। কোরিয়া পর্যন্ত একলা। এয়ারপোর্টে সব ফরমালিটি শেষ করে বের হলাম। ইমিগ্রেশন অফিসারটা অবশ্য আমার চেহারাটা অনেকক্ষন ধরে দেখলো, বাদামী রং আবার বাংলাদেশী কিনা।

বাইরে এসে দেখি বন্ধু নেই, আসার কথা এতক্ষনে। হংকং এয়ারপোর্টে মেইল চেক করেছিলাম লাষ্ট। ও বলে দিয়েছিলো দুপুর ৩টার মধ্যে ও না আসলে যেনো ইন্সট্রাকশন মতো Suwon-এ হোটেল ক্যাসল পর্যন্ত বাসে চলে যাই। পরে শুনেছি ওর প্রফেসর অনুমতি দেয় নি বিধায় ও আসতে পারে নি। এয়ারপোর্টে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের বাটপারি ওখানেও আছে, তবে অনেক কষ্টে ভাংগা ইংরেজীতে Suwon যাওয়ার বাসের কাউন্টার আর বাসের খোজ পেলাম। মোটেই দুরে না, তবে বুঝতেই সমস্যা। ওদের অধিকাংশই ইংরেজী বুঝে না। এই নিয়ে অনেক মজার ঘটনাটা আছে। বলা যাবে প্রসংগ এলে। যাহোক, বাস থেকে নেমেই দুই বন্ধুতে কোলাকুলি। কি তীব্র ঠান্ডা! ০-১ ডিগ্রী সেলসিয়াস নাকি ছিলো। আমি কাপছিলাম। বন্ধুর সাথে ওর বাসায় গেলাম বাসে করে, গল্প-গুজবে রাতটা কাটালাম। বন্ধু একটা ইলেকট্রিক বেড দিলো, ওর কাছে ছিলো এক্সট্রা। পরদিন রওনা দিলাম বুসানের উদ্দেশ্যে।

৫ ঘন্টার জার্নি শেষে পৌছালাম বুসান, বাসস্ট্যান্ড থেকে ফোন করলাম কৃষ্ণাকে। ফোন কার্ড কিনে নিয়েছিলাম Suwon-থেকেই। কৃষ্ণা এলো এক সিনিয়র কোরিয়ান ল্যাবমেটকে নিয়ে, ইয়ানজে। পরিচয় হলো দুইজনের সাথে। ইয়ানজে আমার দেখা খুব অল্প কয়েকজন কোরিয়ানদের একজন, যারা মানুষ হিসেবে খুব ভালো ছিলো!

রওনা দিলাম ডরমেটরীর উদ্দেশ্যে। ভন্ডামী উন্মোচন শুরু হলো….।

পরের পর্বঃ হোয়াট এ ওয়েলকাম! এবং অতঃপর…..

Thursday, December 11, 2008

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-১)

ব্লগে আমার কাছের মানুষগুলো হয়তো জানেন আমি কোরিয়া থেকে অষ্ট্রেলিয়ায় চলে এসেছি পিএইচডি’র জন্য। এ আসাটা কিন্তু শুধু ভালো একটা সুযোগ লুফে নেয়া নয়। পেছনে আছে অনেক কষ্ট, কিছু লোকের মিথ্যাচার-ভন্ডামী আর নিজের ভবিষ্যত ভাবার চাপ। তাই নিয়ে একটা সিরিজ শুরু করছি। টেনে নেয়টাই হবে চ্যালেন্জ।

সিরিজটা কোন জাতি-গোষ্ঠিকে আঘাত দেয়া বা খারাপ ভাবে উপস্থাপনের জন্য নয়, একান্তই আমার নিজস্ব অভিজ্ঞজ্তা আর উপলব্ধি বলে যাওয়া। শুধু জানার জন্যই জানুন, কেউ হয়তো সাবধান হতে পারবেন। এটাই যথেস্ঠ।

উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ কোরিয়ার যাওয়ার প্রেক্ষাপট ও যোগাযোগ

যে পেশায় আছি তাতে শিক্ষা-গবেষনায় একটা বড় ডিগ্রী না হলে হয় না। ক্যারিয়ারকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে খুব দরকার একটা পিএইচডি। নিজের তো অত টাকা নেই, তাই রেজাল্টের উপর ভরসা করে বিভিন্ন দেশে স্কলারশীপের আব্দার। এ আব্দার সহজেতো পুরন হয়না, রেজাল্টের সাথে লাগে নিজেকে সঠিকভাবে উপস্থাপন আর ভাগ্য অবশ্যই। আমার কেন জানি সব মিলছিলো না। টার্গেট ছিলো ইউরোপ, সেই ভাবেই এগুচ্ছিলাম, একটা অফার কানের খুব কাছ দিয়ে বের হয়ে যাবার পর টনক নড়লো, বুঝলাম এইভাবে দেরী হয়ে যাচ্ছে। সাথের অধিকাংশই দক্ষিন-পুর্ব এশিয়া টিক দিয়ে পরীক্ষায় পাশ করে যাচ্ছে আর আমি যেখানেই টিক দিচ্ছি, উত্তর ভুল হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা প্রেশার মনের উপর। বিয়ে করে ফেললে তো আরও।

খুব কাছের কয়েকজন যখন কোরিয়া চলে গেলো, তখনও আমার কাছে ক্লিয়ার না কোরিয়ার রিসার্চের রেপুটেশন। আমার তখন ফ্রাসটেশন চলে আসছিলো। ওরা গিয়ে বললো সব ঠিক আছে, চলে আয়। আমার “এটিপি (অল টাইম পজিটিভ)” একজন সিনিয়র কলিগ আছেন, আলাপ করলাম, উনি ভ্রু কুচকে বললেন “দেখো, তবে তাড়াহুড়ো করো না”। মনটা অর্ধেক সায় দিয়েই ছিলো, এবার পুরোটাই রাজী। কোরিয়ান ভার্সিটির ওয়েবসাইটগুলো ঘুরে লেখা শুরু করলাম।

খুব দ্রতই কয়েকটা পজেটিভ রিপ্লাই পেলাম, এর মধ্যে একজন ফুল প্রফেসর, আর কাজও খুব রিলেটেড। সিলেক্ট করলাম তাকেই। পুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির। ওয়ার্ল্ড রেন্কিং এও আছে। আমি স্মার্ট লোকদের পছন্দ করি, লোকটার ছবি আর এ্যাপিয়ারেন্স দেখলাম, খুব স্মার্ট। সে ওয়েলকাম জানালো আর বলে দিলো তার একজন স্টুডেন্টের সাথে যোগাযোগ করতে (মেইলে cc দিয়ে)। ইষ্ট এশিয়ান কালচার। প্রফেসররা কিছুটা দুরত্ব মেনটেইন করেন। যাহোক, সেই পিএইচডি ষ্টুডেন্টের নাম কৃষ্ণা, নেপালী। শুরু হলো মেইলে যোগাযোগ।

আমি প্রথমেই জানতে চাইলাম ল্যাবের বর্তমান রিসার্চ এরিয়া কি? স্পেসিফিক কি কাজ হচ্ছে, আর স্কলারশিপের ব্যাপারটা কি? কিভাবে, কখন আবেদন করতে হয়? কৃষ্ণা কিছু রিসার্চ পেপার পাঠালো, অন্য প্রশ্নের উত্তর নাই। তারও ব্যস্ততা আছে। এভাবে প্রতিনিয়ত মেইলে যোগাযোগ, সব ব্যাপার বলে, স্কলারশীপের কথাটা এড়িয়ে যায়। আমার ‘এটিপি” কলিগের সাথে আলাপ হয়, উনি বলেন সাবধানে হ্যান্ডেল করতে। আমি সাবধানে হ্যান্ডেল করি।

এরই মাঝে এডমিশনের জন্য কি কি লাগবে তার নিয়ে আলাপ চলছে, কৃষ্ণা একটু ভীতু টাইপের, তাই দরকারি-অদরকারি সব ডকুমেন্টস যোগার করতে বলে, আমি একের পর যোগার করি। সেটাও খুব মজার। ওটা এখানে বল্লাম না। রিসার্চ প্রপোজাল নিয়ে কথা হয়, জিজ্ঞেস করি বারবার, লেখতে হবে কিনা? বল্লে লেখে ফেলি। এটাও এ্যাভয়েড করে। মনে আছে আমার, কয়েকদফা কাগজ-পত্র পাঠাতে হয়েছিলো। এর মধ্যে দাদা ডাকা শুরু করলাম। অন্য আর একটা ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া আমার এক বন্ধু বউ-বাচ্চার কথা মনে করে কাঁদে আর কোরিয়ার প্রশংসা করে। আমার বৃহস্পতি তখন তুংগে।

যাহোক, আসল সময় আসলো, স্কলারশীপের কথা। এতদিন টাকা-পয়সার কথা এ্যাভয়েড করতে সমর্থ হলেও এডমিশনের কাগজ-পত্র ফাইনাল করতে গিয়ে চেয়ে বসলো টাকা! বেশী না পরিমানে, ৫০ ইউএস ডলার, তবে এটা একটা মেসেজ, ভবিষ্যতের। আমিও ছেকে ধরলাম, এতদিন পর উল্টা টাকা চেয়ে পাঠাচ্ছো? আমি কিভাবে চলবো তা তো কিছু বলছো না! কিসের ভিত্তিতে আমি টাকা পাঠাবো? তোমরা এত লুকোচুরি খেলছো কেনো? আমার কথা গুলো হজম করতে ৩দিন সময় নিলো। এরপর বললো, ‘তুমি ল্যাব রুল অনুযায়ী এডমিশনের জন্য ৫০ডলার দিবে, মান্থলি পাবে ৫০০ ডলার, এসে স্কলারশীপের এ্যাপ্লাই করবে, তোমার রেজাল্ট-IELTS স্কোর-পাবলিকেশন আর প্রফেরসরের রেপুটেশনের জন্য স্কলারশীপ পাবার সম্ভাবনা ১০০ ভাগ। স্কলারশীপ ৯০০ ডলার, তখন প্রফেসর তোমার টিউশন ফি দিয়ে দিবে, ইভেন তোমার পারফরমেন্সে খুশী হয়ে আরও কিছু এড করে দিতে পারেন।” প্রথমে থমকালাম, মাত্র ৫০০! আর নিজের স্কলারশীপের ব্যবস্থা না করে কি যাওয়া ঠিক হবে? আরেকজনের মুখের কথার উপর বিশ্বাস করে? বিশ্বাস কিন্তু করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। স্কলারশীপ পেলে তো পুরো ৯০০ আর প্রফেসর নিজের ফান্ড থেকে কিছু নাকি দেবে! কোরিয়ায় থাকা আর ডিগ্রি করে আসা কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ হলো, উনারা বললেন, বলেছে যখন তখন বিশ্বাস করো, স্কলারশীপ পেলে তোমাকে আর পায় কে? আর এই টাকাতেও দুইজন চলতে পারবে(!)। শুধু একজন ঐ ইউনি থেকে মেইল করে বল্লো আবার ভেবে দেখতে, প্রফেসর নাকি সুবিধার না। সংখ্যাতত্ত্বে হেরে গেলো সে, আর মনে হলো লোকটা আমার ভালো যায় না, হিংসুক, ইত্যাদি। আমি একপা দিয়েই ছিলাম, এবার দু’পায়েই রাজি। রাজি হলাম, ৫০ ডলার পাঠিয়ে দিলাম। ২০০৬ এর অক্টোবরে। ডিসেম্বরে জানালো এডমিশন হয়ে গেছে, সব ঠিক ঠাক। মার্চ থেকে সিমেস্টার শুরু, আমি আরো আগে গেলে ভালো, রিসার্চ শুরু করে দিতে পারবো।

আমি আকাশে উড়ছি, বাবা-মা-বউ আর এটিপি স্যারের সাথে আলাপ করে ঠিক করলাম, জানুয়ারী তে যাবো, এপ্রিলের মধ্যে বউকে নিয়ে যাবো…..। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।

আমি আসলেও বোকা ছিলাম, খুব বোকা। বোকা আর সরল, খুব সহজে মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলার মত। আমার ভবিষ্যতটাও সেভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলো। শুরু হলো আমারও প্রস্তুতি…।

পরের পর্বঃ প্রস্ততি, আরেক ভন্ডামী, খুশীর খবর এবং যাত্রা।

ছিন্নমুলের যাত্রাঃ সূচনা

দেশ ছেড়েছি সেই ২০০৭-এ। প্রথমেই অষ্ট্রেলিয়া না, গিয়েছিলাম কোরিয়ায়। পিএইচডি করতেই। ভাগ্য ভালো না। পরিবেশ-পরিস্থিতি মিলিয়ে টিকে থাকা হলো না কোরিয়ায়। স্কলারশিপ নিয়ে চলে এলাম এখানে। সে টিকতে না পারাও একটা তিক্ত কাহিনী। আমারব্লগে সে কাহিনী দিয়েছি একবার।

এখানেও পোষ্ট করবো ধারাবাহিকটি।

Wednesday, December 10, 2008

প্রথম পোষ্ট

ধারাবাহিকভাবে কিছু লেখে যাবো এই ভেবে শুরু করিনি এই ব্লগ। হঠাৎ মনে হলো থাক না একটা নিজস্ব-আপন ব্লগ, কিছু মনে হলে ধরে রাখবো। ডাইরীর মত লিখতে পারলে ভালো হত।

সাইটটা তেমন সাজাইনি। ওপেন করেই লিখতে বসেছি।

নিজের প্রবাস জীবনের কথাই লিখে যাবো।

কেউ পড়লে আওয়াজ দিয়েন।