প্রিয় উক্তি......

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়..........

Monday, December 15, 2008

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-৩)

হোয়াট এ ওয়েলকাম! এবং অতঃপর…..

বাস স্ট্যান্ড থেকে ইয়ানজের গাড়ীতে করে রওনা দিলাম ইউনিভারসিটির দিকে। লাগেজ গুলো খুব ভারী ছিলো, উঠাতে খুব কষ্ট হয়েছে, ঢাকার নিউমার্কেট থেকে কেনা স্যুটকেসটা বিমান থেকে পড়লেও ভাংগবে না গ্যারান্টি দেয়া হলেও কোরিয়ায় বাস থেকে নামতেই হ্যান্ডেল ভেংগে শেষ। তাই পাঁজাকোলে করে গাড়ীতে তুলতে হয়েছে।

পথে কৃষ্ণা আর ইয়ানজে মিলে ঠিক করলো আগে ল্যাবে না গিয়ে ডরমেটরীতে যাবে, আমার লাগেজ রেখে পরে ল্যাবে যাওয়া হবে। কোরিয়া মানেই পাহাড়, উচু নিচু রাস্তা পার হয়ে একটু উচুতে একটা রাস্তায় গাড়ীতে থামলো। একটা গলির ভেতরে দোতালা একটা বাড়ির সামনে লাগেজ টেনে-হিচড়ে নিয়ে গেলাম। দেখা গেলো চাবি নেই কারো কাছে? ক্লান্তির মধ্যে এমন দেখলে বিরক্তিই আসে। আপাতত বড় আর মাঝারি লাগেজ দুটা বাড়ির সামনের একটা এক্সট্রা রুমে রাখা হলো, কোন নিরপত্তা ছাড়াই। স্লাইডিং কাচের দরজা, তালা নেই। আমাকে অভয় দিলো কিছু হবে না। সমস্যা হয়নি অবশ্য।

এবার আবার প্যাচিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আবার উঠে পৌছালাম ইউনিভারসিটি। কাধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে তীব্র শীতটা ওভারকোটে ঢাকার চেষ্টা করতে করতে বহুতল একটা ভবনে ঢুকলাম ওদের সাথে। লিফটে ৫ নং ফ্লোরে উঠে ওদের পিছু পিছু গিয়ে ঢুকলাম ল্যাবে। বলা হলো প্রফেসর লি রুমে বসে আছেন, গিয়ে দেখা করে আসো।

ল্যাবের ভেতরেই তার আলাদা রুম। গেলাম। সম্ভাষন দিয়ে পরিচয় দিলাম। একটা শুকনা হাসি দিয়ে হাক দিয়ে উঠলো “কৃষ্ণা”। কৃষ্ণা পড়িমড়ি করে ছুটে এলো (দৃষ্টিকটু ভাবেই), প্রফেসর বল্লো “ওকে ডরমেটরী দেখিয়েছো?” হ্যা উত্তর পেয়ে আমার দিকে তাকালো, বল্লো, ল্যাব ডরমেটরীতে থাকতে ১০০ ডলার তো লাগবেই, সাথে এসটাবলিসমেন্ট কস্ট হিসেবে আরো ১০০ ডলার দিতে হবে। আর নেক্সট সোমবারে নিজের উপর একটা প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। আমি বিহবল!

মানসিক-শারীরিক ধকল আর এক্সপেকটেশনের আনেক্সপেকটেড অবস্থা দেখে আমি আসলেও বিহবল! শুধু বলতে পারলাম “ওকে!”। এই ওকে দিয়েই পরবর্তিতে অনেক ঝামেলা এড়িয়েছি। বাকী আলাপ পরে হবে আর ল্যাবমেটদের কাছ থেকে সব জেনে নিতে বলে সাক্ষাত পর্ব শেষ হলো।

বেলা তখন দুপুর ২.৩০-৩.০০টা। ক্ষুধাও লেগেছে। কোন সকালে বন্ধুর বাসা থেকে খেয়ে বের হয়েছি বাসের জন্য। ল্যাবে সবাই যেমন ব্যস্ত, বলার ইচ্ছে হলো না। আর মাথায় তখন ঘুরছে দুটো জিনিস। বাসায় ফোন করা আর বেড কিনা। নাইলে এই ঠান্ডায় ঘুমাবো কোথায়?

দু’একজন ল্যাব-মেটের সাথে পরিচয় হওয়া শুরু হলো। সবার ব্যাপারে বিস্তারিত বলবো পরের কোন পর্ব।

কৃষ্ণাকে বললাম একবার বেড কেনার কথা। সে বললো একটু পরই যাবে। এই একটু পর অবশেষে হলো সন্ধ্যা। আসলে কৃষ্ণার কিছু করার নেই। সে চেনেনা কোথা থেকে কিনতে হবে। কয়েকমাস আগে প্রকাশ নামে একজন ইন্ডিয়ান পোষ্টডক হিসেবে এসেছে, সে চেনে, সে নিয়ে যাবে। সন্ধ্যায় গেলাম একসাথে। সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসেরও যা দাম! তার মধ্যেই দামাদামি করে একটা কমপ্লিট বেড কিনলাম (খাট এর মত ফ্রেম, তার ভেতরে প্লাস্টিকের স্টেজ, আর মোটা গদি), ডবল সাইজড। ৬০ ডলার! ডেলিভারী দিয়ে গেলো বাসায় আরো ১০ডলারে। ঐ ট্রাকেই আমরা ডরমেটরীতে। এইবার খোলা হলো নীচতলা। আমার জন্য নির্ধারিত রুমে গেলাম, ময়লা একটা রুম। খাটটা পাতা হলো। আমার লাগেজ টেনে ভিতরে নিলাম।

রুমে প্রচন্ড ঠান্ডা! বন্ধুর বাসায় দেখেছি হিটার চলে ঠান্ডায়। তাই এখানেও হিটার আছে ধরে দেয়ালে থাকা হিটারের সুইচ দিলাম, কৃষ্ণা হেসে জানালো ঐ হিটার চলে না। অর্থ্যাৎ তেলের কেন্দ্রীয় হিটারটা নাকি গত বছর ব্রাস্ট হয়েছে, ঠিক করা হয় নি। এখন সবাই একটা করে গ্যাস হিটার চালায় যার যার রুমে, তবে অক্সিজেনের অভাবে বেশীক্ষন নাকি চলতে পারে না। আমি ভয় পেলাম, তখন মনে পড়লো বেড হিটার তো আছে আমার, তবে কোন ব্ল্যাংকেট নেই, ঠান্ডায় তো রাতে মরে যাবো। বেড হিটার দিয়ে নীচে গরম হবো উপরে তো হিম-ঠান্ডা, নাক-মুখ তো জমে যাবে! ব্ল্যাংকেট কিনতে হবে!

কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেলো, কৃষ্ণা রাতে নিয়ে যাবে কোন মার্কেটে ব্ল্যাংকেট কিনতে। ক্লান্তি পুরো শরীরে, তাও ঐ জন্য যেতেই হবে। কৃষ্ণা খুব হেল্পফুল আর সামাজিক একটা মানুষ, ধরে নিয়ে গেলো খাবারের জন্য। ওর বউ-বাচ্চার সাথে পরিচিত হলাম। ভাত-সব্জি টানলাম ভালোই। রান্না আমাদের মতই, একটু ধনিয়া আর পাঁচ-ফোড়ন বেশী দেয়। আর কারী-পাতা দেয়। চিনতাম না এই পাতা। সেদিনই চিনলাম।

কৃষ্ণার সাথে ল্যাবে গেলাম আবার রাত ৭.৩০টার দিকে। প্রফেসর ছাড়া সবাই আছে ল্যাবে! এটাই নাকি স্বাভাবিক, এবং থাকে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত! একটু অবাকই হলাম। শংকিতও! আমার দুঃশ্চিন্তা, মার্কেট তো বন্ধ হয়ে যাবে। কৃষ্ণা অভয় দেয়, পাওয়া যাবে। দু’চোখে ভীষন ক্লান্তি-ঘুম-দুঃশ্চিন্তা। এর মাঝে ফোন করে বাসার সবাইকে দুঃশ্চিন্তা মুক্ত করা। কৃষ্ণা খুব ব্যস্ত, সো ল্যাব থেকে বের হতে হতে রাত ১১টা। রাতে হোমপ্লাস (Homeplus) নামের কোরিয়ার এক চেইন-স্টোরে গিয়ে লেপ/ব্ল্যাংকেট কিনলাম, ৩০ ডলার। সাথে সকালের জন্য কিছু খাবার। হেটে ফিরলাম বাসায়, তখন রাত ১২.৩০।

প্রচন্ড ক্লান্তির মধ্যে বিছানা গুছিয়ে, বেড হিটার লাগিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে নিতেই ঠান্ডায় জমে শেষ। কারন ঘরে কোন হিটার নেই। তাপমাত্রা মাইনাস, দেশী আরামদায়ক শীতে অভ্যস্ত আমি কাপছি রিখটার স্কেলে ৮টার তীব্রতায়। দ্রুত লেপের নীচে ঢুকে গেলাম। হাত-পা ঘষতে ঘষতে চলে গেলাম ঘুমের রাজ্যে। পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে….

ও বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, ল্যাবে যেতে হবে সকাল ৮.৩০টার মধ্যে, এটাই নিয়ম, নাইলে খবর আছে……। কি খবর? পরের পর্বে বলছি।

পরের পর্বঃ ল্যাব রুল, ল্যাব ম্যানেজমেন্ট পলিসি, আর ডরমেটরী ব্যবসা।

(বেশী বড় হয়ে গেলো বলে এই পর্বে ডরমেটরীর আসল ভন্ডামির কাহিনী পুরা বলা হলো না, হবে নেক্সট পর্বে)

2 comments: