প্রিয় উক্তি......

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়..........

Tuesday, December 23, 2008

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-৫)

ল্যাব রুল ও ল্যাব ম্যানেজমেন্ট

ডরমেটরীর কথা তো বলা হলো, এবার ল্যাবে যাই।

ঠান্ডায় শক্ত হয়ে যাওয়া ব্রেড আর দুধ গিলে রওনা দিলাম ল্যাবের দিকে কৃষ্ণার সাথে। সকাল ৮.৩০টার মধ্যে পৌছাতে হবে, কারন এটা ল্যাব রুল! প্রথম দিনেই আজারবাইজানী ল্যাবমেট আর কৃষ্ণা বলে দিয়েছিলো অনেক ল্যাব রুলের কথা। পরে আরো জেনেছি। অনেক রুল………। সেগুলো নীচে তুলে ধরছি।

ল্যাব রুল
১। সকাল ৮.৩০টার মধ্যে আসতে হবে, এবং ফ্রীজের সাথে ঝুলানো সীটে যার যার নামের পাশে বার অনুযায়ী আসার সময় লেখতে হবে।
২। প্রতি সোমবার প্রফেসর এর সাথে আলোচনা করতে হবে রিসার্চ নিয়ে। একটা বোর্ডে চলতি গবেষনার অগ্রগতি নোট করে আলোচনা করতে হবে। .
৩। প্রতি সপ্তাহের একটা করে ল্যাব মিটিং হবে। মিটিং এ সব মেম্বারকেই কিছু না কিছু করতে হবে। কেউ রিসার্চ পেপার প্রেজেন্ট করবে, কেউ বা নিজের রিসার্চ, কেউবা ল্যাবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জানাবে। এটার একটা সিডিউল ও আছে।
৪। প্রতি মাসে সবাইকে রিপোর্ট জমা দিতে হবে।
৫। ল্যাবের নতুন মেম্বাররা ল্যাব ধোয়া-মোছার কাজ করবে। প্রতিদিন।
এছাড়া আরও অনেক ছোট-খাটো নিয়ম আছে। ইস্যু ভিত্তিক। প্রসংগ এলে বলবো।

রুল গুলো শুনতে খুব ভালো লাগে। মনে হয় ল্যাবটা খুব অর্গানাইজড। আমারো তাই মনে হয়েছিলো। বিশেষ করে যে ভাবে প্রথমে বলা হয়েছিলো। এবার দেখি এসব রুলে কি সমস্যা ছিলো, আর রুল গুলো না মানলেই বা কি হতো?

সকাল ৮.৩০টার মধ্যে না আসতে পারলে রেকর্ড থাকতো, এবং এরকম ঘটনা ৩/৪ বার ঘটলে মাসিক স্যালারী কাটা হতো। ল্যাবের সিনিয়র মেম্বারদের এর তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেক আছে। আবার সব সময় খুব আর্লি আসতে পারলে ৫০ ডলার ইনসেনটিভ দেয়ার কথা ছিলো। শোনা যায় মংগোলিয়ান মেয়ে দুটা নাকি এটা পেতো। যদিও তারা অস্বীকার করতো। ওরা আসতো ৮.১৫ এর দিকে, টাইমশীটে লেখতো ৭.৩০টা। এটা আমাদের জন্য ছিলো একটা ডেইলী বিনোদন। আর এত কড়া নিয়মের কারনে সকাল সকাল সবাই এসে একটু পর বেরিয়ে গিয়ে ফাকি মারতো। প্রফেসর জিজ্ঞেস করলে বাধা উত্তর “গ্লাস হাউজে গেছে”।

প্রতি সোমবার প্রফেসরের সাথে রিসার্চ নিয়ে আলোচনা হবে। খুব ভালো শোনায়। কিন্তু আলাপটা একতরফা। “ইউ শুড নো..ইউ ডোন্ট নো….গারবেজ আইডিয়া…. ডোন্ট এক্সপেক্ট এনিথিং ফ্রম মি….ইউ হ্যাভ টু থিংক…. থিংক, থিংক….ডোন্ট জাস্ট থিংক….ডু সামথিং……ট্রাই টু কনট্রিবিউট সামথিং ইন ল্যাব…. মেক মি ফ্যামাস…..”। কেউ ডিসকাশনে গেলে প্রফেসরের রুম থেকে এসব ডায়ালগ ভেসে আসতো। আলোচনার জন্য যাওয়ার আগে স্টুডেন্টের চেহারা থাকতো ভয়ার্ত। আর ফিরে আসার পর অপমানে লাল। তারপর যে যার ভাষায় গালাগালি চালাতো। তার জন্য কারও মনে সম্মান দেখি নি। যারা পাশ করে গেছে, তাদেরও না, যারা ল্যাবে আছে, তাদেরও না। কারন ঐ ইউনিভারসিটির কুখ্যাত তিনজন প্রফেসরের একজন তিনি, যাদের বিরুদ্ধে ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছে। ল্যাব মেম্বারদের মুখে মুখে বুলি ছিলো “ডু সামথিং”। এখনও ওদের অনলাইনে চ্যাট হলে এই কথাটা চলে আসে। আর হ্যা, রিসার্চ ডিসকাশনে না গেলেও স্যালারী কর্তন।

প্রতি সপ্তাহে ল্যাব মিটিং হবে। আমি যখন যাই তখন ফিক্সড ছিলো সোমবার সন্ধ্যা। ক্লাশ শুরু হবার পর সোমবার সন্ধ্যায় ক্লাশ থাকায় মিটিং গেলো শুক্রবারে। কৃষ্ণা ল্যাব এক্টিভিটিস এর লিডার। তাই তার কাছে প্রফেসরের ওহী আসতো, কৃষ্ণা সবাইকে ইমেইলে জানিয়ে দিতো সেই বানী, কয়টায় হবে মিটিং, সিডিউল অনুযায়ী কে কি প্রেজেন্ট করবে। সবারই ছিলো ল্যাব মিটিং নিয়ে ভীতি। পারলে কোন রিসার্চের অজুহাতে ফাকি দিতো। কারন মিটিং এ সবার সামনেই প্রফেসর ফাউল কথা বলে অপমান করতো। এবং একজনকে দিয়ে আরেকজনকে অপমান। যাতে মেম্বারদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ থাকে। কোন পাবলিশড পেপের প্রেজেন্ট করলে বলতো, হোয়াট ইজ নিউ? কৃষ্ণা একবার খেপে বলেছিলো, পাবলিশ তো হয়ে গেছে, নতুন কি পাবে। সে মুখ লাল করে কৃষ্ণাকে স্টাবোর্ন বলে গালি দিয়েছিলো। সবচে খারাপ অবস্থা হতো রিসার্চ প্রেজেন্টেশনে। যেমন প্রফেসর, তেমন তার স্টুডেন্টরা। রিসার্চের কোথায় কি ভুল, কি করা হয় নি, সবার এসব নেতিবাচক কথা-বার্তায় ভরে উঠতো রুমটা। ভয়ে কেউই প্রেজেন্ট করতে চাইতো না। সবচে শান্তি ছিলো ল্যাবে যার যার দায়িত্ব সম্পর্কে জানানো। একটা বলে দিলেই হলো, একি কুমিরের বাচ্চা বার বার। আমার দায়িত্ব ছিলো কম্প্যুটার। কয়টি, কিভাবে, কোন কাজে আছে তার রিপোর্ট দেয়া। এখানেও উপস্থিত না থাকা বা প্রেজেন্ট না করার শাস্তি স্যালারী কর্তন।

মান্থলি রিপোর্ট জমা দিতে হবে। অর্থ্যাৎ আগের মাসে কি করা হয়েছে। রিপোর্ট পেলেই স্যালারী হতো। না হলে না।

ল্যাবের নতুন মেম্বাররা ল্যাবের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে থাকবে। কেউ ফাকি দিলে, এবং রিপোর্ট হলে স্যালারী কর্তন।

মোট কথা এত কড়া নিয়ম আর স্যালারী কাটার হুমকীর কারনে সবাই ছিলো অসুখি। কথায় কথায় স্যালারী কাটার খোটা। আমাকে ২য় দিনেই বলা হলো, এসব না করলে তোমার স্যালারী কেটে নেবো। বল্লো স্বয়ং প্রফেসর। স্টুডেন্টরা ওখানে স্লেভ এর মতই ছিলো।

ল্যাব ম্যানেজমেন্ট
ল্যাব ম্যানেজমেন্ট মানে বলতে চাচ্ছি ল্যাব চালাতে প্রফেসরের স্ট্রাটেজি কি ছিলো।
ল্যাবের মুল ফান্ডিং হতো বিভিন্ন রিসার্চ প্রজেক্ট হতে। অনেক গুলো রিসার্চ প্রজেক্ট ছিলো, কয়েকটা ছিলো অনেক দীর্ঘমেয়াদী, বাজেটও ছিলো অনেক। বড় বড় রিসার্চ প্রজেক্টগুলোর ফান্ডিং হতো ব্রেইন কোরিয়া-২১(বিকে-২১) নামক প্রোগ্রাম দিয়ে। বিভিন্ন প্রজেক্টে এক একজন স্টুডেন্ট রিসার্চার হিসেবে থাকতো। প্রফেসর বিকে-২১ এর লোকাল হেড। তাই এক কুমির বারবার দেখানোতে প্রবলেম হতো না। অর্থ্যাৎ একি স্টুডেন্টকে কয়েকটা প্রজেক্টে দেখানো।

বিকে-২১ থেকে একজন স্টুডেন্ট পেতো ৯০০ ডলার। কোর্স সিমেস্টারে মাসিক ২৫০ ডলার টিউশন ফি দিলে হাতে আসার কথা ৬৫০ ডলার। যাদের নিজের একাউন্টে এই টাকাটা আসতো তারা এই ২৫০ডলার উঠিয়ে দিয়ে দিতো ল্যাব অফিসে, আর তার সাথে উপরি হিসেবে আরো ১৫০ ডলার দিয়ে দিতে হতো। প্রফেসারের নির্দেশে নিজের স্যালারি থেকে ১৫০ডলার দিয়ে দেয়া কে উপরি বলবো নাতো আর কি বলবো। আরো ১০০ ডরমেটরির চার্জ। চলতে হতো ৪০০ ডলারে।

কোর্স সিমেস্টার শেষ হয়ে গেলে টিউশন ফি লাগতো না, তখন ল্যাবকে কত দিতে হতো বলুন তো? ১৫০ ডলার? হলো না, পুরো ৪০০ (২৫০+১৫০) ডলার, ডরমেটরি চার্জ ছাড়া। এতটাই জোচ্চর ছিলো ওরা। আমরা যারা জুনিয়র ছিলাম, তাদের টাকাটা কায়দা করে ল্যাব একাউন্টে আনা হতো, আর আমাদের একাউন্টে সরাসরি ৪০০ দেয়া হতো (ডরমেটরির জন্য ১০০ কেটে)। যাওয়ার পরপরই চুক্তিপত্রে সাইন করতে হতো, সব কোরিয়ান ভাষায়, বুঝার কোন উপায় নেই। জিজ্ঞেস করলে বলে, এমনি ফরমালিটি। আসলে চুক্তি অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ করার কথা। সেটা লুকানো হতো। আমি জেনেছি আরো পরে নিজে পড়তে জানার পর, অন্যদের সাথে কথা বলার পর।

ভাষার জন্য বিদেশী স্টুডেন্টরা কিছু বুঝতো না। আবার ৩য় বিশ্বের কোন দেশ থেকে এলে কোরিয়ান গভর্মেন্ট হতে তখন ছাত্র প্রতি স্পেশাল গ্র্যান্ট আসতো, সেটাও জানা যেতো না। এছাড়া ছোট-খাটো এককালীন কিছু স্কলারশীপ ছিলো, বই-স্টেশনারী বা গবেষনার জন্য ছোট-খাটো খরচের জন্য। এগুলো সব প্রফেসর আর তার কোরিয়ান ছাত্র-অফিসাররা দেখভাল করত, আমাদের পক্ষে অ্যাপ্লাই করতো। টাকাটা আমাদের একাউন্টে এককালীন চলে আসতো আর আমরা শুধু কয়েকমাস পর পর নিজেদের একাউন্ট হতে হঠাৎ ভুলে চলে আসা কয়েকশ হতে হাজার ডলার প্রফেসরের কথা মতো উঠিয়ে দিতাম। এই জন্য ভুলে চলে আসা বল্লাম, কারন আমাদের বলা হতো “তোমার একাউন্টে ভুলে কিছু টাকা চলে গেছে, উঠিয়ে দিয়ে দাও”। সবারই একি অভিজ্ঞতা। মজার ব্যাপার হলো টাকাটা হাতে হাতে চায় তারা, ব্যাংক ট্রান্সফার করতে রাজী না, কারন তাতে রেকর্ড থাকবে, স্টুডেন্টরা চাইলেই অভিযোগ করতে পারবে এই দুই নম্বরীর। আমি এই নিয়ে মজা করতাম, জোর করে বলতাম ট্রান্সফার করি, সমস্যা কি? ওরা খেপতো খুব। আর এটা এড়াতে ইয়াংজেকে দিয়ে আমাকে বলাতো, কারন ওর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো।

আবার দেশের মধ্যে বিভিন্ন কনফারেন্স-সেমিনারে যাওয়ার জন্য বিকে-২১ এর ফেলোশীপ হোল্ডারদের ১০০-৩০০ ডলার দেয়া হতো। এটা কখনই আমরা পাই নি। শুধু মাঝে মাঝে কোরিয়ান টাইপ করা কাগজে সাইন করতাম। ইয়াংজে কে জিজ্ঞেস করলে হেসে বলতো ঐ একটা কনফারেন্স এর টাকা, বাদ দাও।

এই সব কারনে বিদেশী ছাত্র আর রিসার্চররা প্রফেসরের খুব প্রিয় ছিলো। ম্যানিপুলেশন বেশি করা যায়, নিরাপদ।

ততদিনে প্রফেসরের একটা নামও দিয়ে দিয়েছি আমি আর কৃষ্ণা মিলে। “বুড্ডা”। আরো অনেক নাম প্রস্তাব করা হয়েছিলো, কিন্তু এটা সিলেক্ট করার কারন হলো প্রফেসর কিছু হলেই গুগল সার্চ দেয়, আর বুড্ডা সার্চ দিলে গৌতম বুদ্ধই আসবে রেজাল্টে। সো ধরা পড়লেও আমরা সেইফ।

পরের পর্বঃ ল্যাব মেম্বারদের পরিচিতি

No comments:

Post a Comment