প্রিয় উক্তি......

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়..........

Tuesday, December 23, 2008

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-৬)

আজকের পর্বঃ ল্যাব মেম্বারদের পরিচিতি

পুরো কাহিনী শেষ করতে ল্যাব মেম্বারদের কথা বারবার আসবেই, তাই সবার একটা পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করছি।

ল্যাবে প্রফেসর লি ছাড়াও ছিলেন আরো দুইজন রিসার্চ প্রফেসর, একজন ইনভাইটেড/ভিজিটিং প্রফেসর, দুইজন পোষ্টডক্টরাল রিসার্চার, নয় জন পিএইচডি স্টুডেন্ট। স্টাফ হিসেবে হিসেবে আরো পাঁচ জন। এদের সংক্ষেপে পরিচিতি দিচ্ছি।

প্রফেসর লিঃ ল্যাবের প্রধান ব্যক্তি। পটেনশিয়াল অনেক ছিলো, খুব ভালো মানের একজন রিভিউয়ার। কিন্তু টিন-এজার টাইপ হিরোইজম, স্বেচ্ছাচারীতা, টাকা-পয়সা নিয়ে দুনম্বরী আর জীবনটা উপভোগের ধান্ধায় (খেলাধুলা আর মদ্যপান অর্থে) রিসার্চ লাইফটাই শেষ তার। সারাদিন ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। আর উকি-ঝুকি মারে কে কি করে? কার ভুল ধরা যায়? নিজের ফাকিবাজিটা ঢাকতে অন্যের উপর ঝাড়ি দেয়াই তার স্বভাব। শিক্ষক হিসেবে খুব ভালো মনের, আমাকে আধা-ঘন্টাতেই কোরিয়ান এলফাবেট সব উচ্চারন সহ চিনিয়ে দিয়েছিলো। যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করা নিঃসন্তান এই লোকটা পারত পক্ষে কারো প্রশংসা করতো না, পজিটিভ কথা বলতো না। সব সময় তার ধারনা ছিলো স্টুডেন্টরা সময় নষ্ট করছে, আর তার টাকার অপচয় করছে। কমন ডায়ালোগ “হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? ডু সামথিং”।

ডঃ ইসমাইল জুলফিগারভঃ
ল্যাবের সিনিয়র রিসার্চ প্রফেসর। প্রফেসর লি’র পরেই তার অবস্থান। আজারবাইজানের নাগরিক। খুব মেধাবী একজন সায়েন্টিস্ট, তবে জায়গামত কনফিডেন্ট না। ল্যাবের ভিতরে রাজা, সব জানেন, সব বুঝেন, আর প্রফেসর না থাকলে প্রফেসর এর মতই ভংগী নিতে ভালবাসেন। জন্ম কম্যুনিষ্ট সোভিয়েত আমলে, তাই মুসলিম হিসেবে পরিচিত হলেও প্র্যাকটিসিং না। বরং কেউ হালাল-হারাম মানলে বিদ্রুপ করেন। পাল্টা যুক্তি দিলে রণে-ভংগে দেন। নেগেটিভ পয়েন্ট বিপরীত লিংগের প্রতি তীব্র দুর্বলতা। ল্যাবেই অতীতে অনেক মুখরোচক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। ল্যাবের পুরুষ স্টুডেন্টদের সাথে কোন রিসার্চ প্রজেক্ট করতে উৎসাহী না, শুধু মেয়েদেরকেই পছন্দ। বেশি পছন্দ ছিলো মংগোলিয়ান মেয়ে দুটা। বয়স এখন ৫০ প্রায়। স্ত্রী আর দু’ছেলে নিয়ে সংসার। এই বয়সে আর কোথাও ভালো সুযোগ পাবেন না বিধায় ল্যাবেই নানা ভাবে স্থায়ী হবার চেষ্টা করেন, এই জন্যই প্রফেসর যা বলেন উনিও তার সাথে একমত, একটু তেল আরকি! এখনও বহাল তবিয়তেই আছেন!

ডঃ সুজাতা রানি মিশ্রাঃ ল্যাবের ২য় রিসার্চ প্রফেসর, ফান্ডিং পেতেন ব্রেইনপুল কোরিয়া থেকে। ইন্ডিয়ান, উড়িষ্যার, বাংলা বোঝেন, বলতে পারেন না তেমন। খুব মেধাবি-সফট হার্টেড-পরোপকারী-অবিবাহিতা-নিরামিষাশী শুকনো-লিকলিকে একজন মহিলা। ৪৫ এর মত বয়স। রিসার্চ-কেরিয়ার আর পরিবারের চাহিদা মেটাতে মেটাতে নিজের জন্য আর ভাবা হ্য় নি তার। সারারাত একাই ল্যাবে কাজ করেন, সকাল ৯-১০টার দিকে বাসায় গিয়ে ঘুমান। আবার বিকালে এসে হাজির। কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আমি দিদি বলে ডাকতাম। সত্যিকারের দিদি। যাবার পর থেকে তার স্নেহ পেয়েছি-শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তা ছিলো। আমি খুব অগোছালো, তবুও প্রতিদিন সকালে আমার ডেস্কটা গোছানো পেতাম। আমার ল্যাব ক্লিনিং-এর দিনও উনি আগে ভাগে কিছু করে আমার পরিশ্রম কমিয়ে দিতেন। প্রচন্ড নীতিবান, তবে আত্মভোলা। ল্যাবে তার এই আত্মভোলা স্বভাবের সুযোগও নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো। তার স্যালারি জমা হতো ব্যাংকে, একা মানুষ কত হলো খোজও নিতেন না, এমনি বোকা। একদিন হঠাৎ খেয়াল করলেন ব্যালেন্স নেগেটিভ হচ্ছে, বাড়ছে না। খোজ করতে বেরিয়ে এলো কেঁচো খুড়তে সাপ। ল্যাব অফিস থেকে দিদির একাউন্ট নম্বর চেন্জ করে আরেক ল্যাব স্টাফের নামে দিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তাই ২০০৬ এর শেষ থেকে ২০০৭ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত ৬ মাস তার স্যালারি জমা হয়েছে অন্য একজনের একাউন্টে। জিজ্ঞেস করলে বলা হলো ভুলে আর একজনের একাউন্ট নাম্বার চলে গেছে। মজা এখানেই ভুলে ল্যাবের একজন স্টাফের একাউন্টেই যায়, কোন বিদেশী স্টুডেন্টদের না। সেই টাকা উদ্ধার করতে দীর্ঘদিন লেগেছিলো, অনেকদিন পিছে লেগে থেকেও আরো ৬ মাস। দিদি এখন দেশে ফিরে গেছেন তার চুক্তি সম্পন্ন করে।

ডঃ চাঙ ইয়াং গোহঃ একমাত্র ইনভাইটেড প্রফেসর, কোরিয়ান। তার স্থায়ী কোন চাকুরী ছিলো না। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়েই কাজ করতেন। নিজ এরিয়ায় কয়েকটা খুব উন্নতমানের রিসার্চ পাবলিকেশন ছিলো। আমি যাওয়ার ১ মাস পর ল্যাবে জয়েন করেন। লোক ভালো, তবে শর্ট টেম্পারড। খুব দ্রুত ফেসটা লাল হয়ে উঠতো। তার সাথে আমার একটা রিসার্চ প্রজেক্ট ছিলো। শুরুটা ভালোই ছিলো, কিন্তু তার উপর আমার প্রফেসরের অব্যাহত চাপ ছিলো আমাকে দ্রুত কাজ শিখিয়ে ছেড়ে দেয়ার জন্য। যেন গোহ চলে যাবার পর আমি ঐ লাইনে কাজ করতে পারি, গোহ কে তাইলে আর টাকা দিয়ে পুষতে হবে না। এটা নিয়ে প্রফেসরের সাথে দ্বন্দ ছিলো। সেটা আমাদের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছিলো, প্রজেক্টের অগ্রগতিতেও। তাই শুরুর ৬ মাস পর আমাকে ঐ প্রজেক্ট থেকে উইথড্র করা হয়, যা আমাদের দুইজনের জন্যই স্বস্তিদায়ক ছিলো। আমার স্বস্তির আনন্দ দেখে আমার প্রফেসর খেপেছিলো খুব। গোহ একাই থাকতো ভারসিটিতে, ফ্যামিলি অনেক দুরে। সে আলাদা বাসা না নিয়ে তার চেম্বারেই খেতো, ঘুমাতো। নতুন চুক্তিতে এখন অন্য ভারসিটিতে চলে গেছে।

ডঃ প্রকাশঃ পোষ্টডক্টোরাল ফেলো, ইন্ডিয়ান, কেরালার। ফান্ডিং পেতো বিকে-২১ থেকে। মেধাবী তবে অস্থির-রগচটা আর খুব ভীতু টাইপের। প্রফেসরের সাথে সবসময়ই ঝগড়া লাগতো। ওরা কেউ কাউকে দেখতে পারতো না। তবে ঝগড়ার পর পরই ভয়ে থাকতো প্রফেসর আবার না কি করে! আগেও কয়েকটা ফেলোশীপ কমপ্লিট না করেই ছেড়ে দিয়েছে এই লোক। আমার সাথে খুব মজার সম্পর্ক ছিলো, অলটাইম আমাকে প্রফেসরের এগেইন্ষটে চার্জড আপ রাখতো আর বলতো এখানে কেন মরতে এসেছো, অন্য ভারসিটিতে চলে যাও। কৃষ্ণার সাথে প্রথমে সম্পর্ক ভালো থাকলেও পরবর্তিতে খুব খারাপ হয়ে যায়, ল্যাবের ভেতরেই বিশ্রী ঝগড়া হতো। চুক্তি শেষ ল্যাবের সাথে, চুক্তির শেষে তাকে তার অনেক প্রাপ্যই বুঝিয়ে দেয়া হয়নি, এখন পুসানেই আছে তবে ডিপেন্ডেন্ট ভিসায়, কারন তার ওয়াইফ ওখানেই পিএইচডি করছে।


ডঃ ভাসুঃ
২য় পোষ্ট ডক্টোরাল ফেলো, ইন্ডিয়ান তামিল। খুব ইয়াং। আমারই বয়সী, আগের দুইজনের মত সেও ইন্ডিয়াতেই পিএইচডি করেছে। হাসিখুশী, তবে একটু বোকা টাইপের। অন্য লাইনে পিএইচডি করায় এই ল্যাবে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারতো না, তাই হতশায় ভুগতো। সিনিয়ররা কেউ হেল্প করতো না তাকে, তাই হেল্পের জন্য পিএইচডি স্টুডেন্টদের কাছে আসতো, এইজন্যও সমালোচনা সইতো হতে বেচারাকে। বেশি দুঃখ পেলে আকন্ঠ মদ গিলে কাঁদা ছিলো অভ্যাস। সমবয়সী বলে আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো। প্রফেসরের নামকরনের সময় তার প্রস্তাব করা নাম ছিলো “মুড্ডা”, তামিল ওয়ার্ড, মানে হলো পুরুষাংগ। সেও ল্যাবের সাথে চুক্তি শেষ করে অন্য ভারসিটিতে নিজের অরিজিনাল ফিল্ডে এখন পোষ্টডক্টরেট করছে। ভালো আছে।

কিম হোসাঙঃ কোরিয়ান সবচে সিনিয়র পিএইচডি স্টুডেন্ট। টিপিক্যাল আদু ভাই। বয়স ৪২। ঐ ল্যাবেই আছে মাস্টার্স থেকে। ডিগ্রি আর শেষ হয় না। প্রফেসরের ডানহাত-বামহাত, সকল অনৈতিক কাজের বাস্তবায়ক। ওর ইয়ারমেট ডিপার্টমেন্টের হেড ছিলো, আর ও এখনও ঘানি টানছে। প্রথম থেকেই আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিলো না, কৃষ্ণার সাথে ওর খারাপ সম্পর্কে জের ধরে। যদিও শেষের দিকে সম্পর্ক ভালো হতে শুরু করেছিলো, সেটাও অবশ্য প্রফেসরের নির্দেশে।


ইউ ইয়াং জেঃ
কোরিয়ান পিএইচডি স্টুডেন্ট। বয়স ৩৮-৩৯ হবে। এই ল্যাবেই পিএইচডি শুরু করেছিলো ১০ বছর আগে, প্রফেসরের সাথে বনিবনা না হওয়ায় চলে গিয়েছিলো চাকরীতে। ১০ বছর পরে ফিরে এসে আবার কাজ শুরু করে। প্রফেসর সম্পর্কে ধারনা খুব খারাপ ছিলো, তবে সেটা প্রকাশ করতে চাইতো না। খুবই মেধাবী-মাল্টি স্কিলড একটা ছেলে। ল্যাবের সব সমস্যা সমাধানে ইয়াংজে ছাড়া উপায় নেই। রিসার্চ-কম্প্যুটার-ইলেক্ট্রিক-টেকনিক্যাল সব ব্যাপারে। আমার টেবিল টেনিস খেলার পার্টনার। কোরিয়ানদের মধ্যে সেইই একমাত্র যে অন্যের মতামতকে সম্মান দিতো। পিএইচডি শেষ করে এখন কানাডায় পোস্ট-ডক করছে। যাওয়ার আগে ল্যাবে তার তৈরি সকল এক্সপেরিমেন্টাল ম্যাটেরিয়াল নষ্ট করে দিয়ে প্রফেসরের প্রতি তার অনুভুতির চরম প্রকাশ ঘটিয়ে গেছে।


রোহ ইউঃ
আর একজন কোরিয়ান পিএইচডি স্টুডেন্ট। তবে সে কাজ করতো একটা রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। ল্যাবে মাঝে মাঝে আসতো। কারও সাথে তেমন সম্পর্ক ছিলো না।

রেনা সাফারোভাঃ ল্যাবের প্রথম বিদেশী স্টুডেন্ট, আজারবাইজানি। প্রথম বিদেশী(নি) তাই কালচারাল শকের প্রথম ধাক্কাটা সেই সহ্য করেছে। খুব হেল্পফুল, কোন কিছু শেখানোর সময় পেন্সিলটা কিভাবে ধরতে হবে তাও বলে দেবে। মাত্র ২০০ ডলার দিয়ে চলতে হতো প্রথমে। অনেক কষ্ট করেছে সে। অভাবে স্বভাব নষ্ট, তেলবাজ আর ল্যাবের জিনিসপত্র ব্যাক্তিগত কাজে ইউজ করা তার জন্য মামুলি ব্যাপার। নিজের রিসার্চের জন্য এত খরচ করে যে প্রফেসরের জন্য সে একটা মাথাব্যাথা। নিজের ভাষা আর ইংলিশ ছাড়াও কোরিয়ান-রাশানও ভালো বলতে পারে। এইজন্য সে ডবল এজেন্ট। আমাদের কথা প্রফেসরের কাছে, কোরিয়ানদের কথা আমাদের কাছে এসে বলবে। মুসলিম পরিবার থেকে এসেছে, আড়লে-আবডালে সবই প্রায় খায়, তবে আমার সামনে হালাল-হারাম মানতো। ল্যাবের মংগোলিয়ান মেয়েদুটা তাকে লিডার মানতো। এখনও ডিগ্রী হয়নি, ৫ বছরের বেশি হয়ে গেলো, আশা করছে সামনের সিমেস্টারে হবে।

কৃষ্ণা নাথঃ ল্যাবের ২য় বিদেশী স্টুডেন্ট, নেপালী। আর একটা কোরিয়ান ইউনি থেকে এখানে চলে এসেছে। দেশে ত্রিভুবন ইউনিভারসিটির লেকচারার ছিলো। খুব ভালো লোক-টিপিক্যাল বড় ভাই। খুব ইমোশনাল টাইপের লোক, সবাকে মন খুলে হেল্প করতো, তাই কষ্টও পেতো বেশী। খুব পরিশ্রমী, ল্যাব এক্টিভিটিসের লিডার। প্রফেসরের অনেক গন্জনা তাই তাকে সইতে হয়। কেউ ল্যাব মিটিং এ প্রেজেন্ট করতে না চাইলে কৃষ্ণা চেষ্টা করতো তাকে বাচাতে। অনেক সাফল্য আর ভালো আইডিয়া থাকা স্বত্বেও প্রফেসরের গোয়ার্তুমির কারনে আজও ভালো একটা পাবলিকেশন হয় নি। তার যে কাজ আছে, রেজাল্ট আছে, তাতে এখনই গ্রাজুয়েশন পেতে পারে, তবে রেনা সিনিয়র বলে তাকে দেয়া হচ্ছে না। ঠোটকাটা লোক বলে প্রফেসর-ইসমাইল-হোসাঙ-প্রকাশ কেউই পছন্দ করতো না তাকে। ল্যাব মিটিং এ অনেক বার প্রফেসরকে উচিত জবাব দিয়ে গোয়ার উপাধী পেয়েছে। বয়স হয়েছে ৩৫, তাই গ্রাজুয়েশনের নামে ব্ল্যাকমেইলিং করে প্রফেসর তাকে দিয়ে বিদেশী স্টুডেন্ট পটায়, তাই সে করেছে আমার ক্ষেত্রে। স্ত্রী কিরন আর মেয়ে স্নেহাকে নিয়া সংসার ছিল। কিরন ল্যাবেই স্টাফ হিসেবে কাজ করতো। ৪ বছরের বেশী হয়ে যাচ্ছে, সেও আশা করছে সামনের সিমেষ্টারে গ্রাজুয়েশন পাবে।

অল্তানযায়া টভুঃ যায়া নামেই পরিচিত। মংগোলিয়ান স্টুডেন্ট। বয়সে ৩২-৩৩ হবে। ভালো মেয়ে, রিসার্চেও ভালো, তবে অতোটা মেধাবী না। ডঃ ইসমাইলের সব রিসার্চে সে আছে, কিছু না বুঝলেও তার ডিগ্রী হয়ে যাবে বলে সবার বিশ্বাস। তবে ইংলিশে এত দুর্বল যে কথা বলতে গেলে সেটা উভয় পক্ষের জন্যই অত্যাচার হয়ে যেতো। বাচ্চা দেশে রেখে স্বামীকে নিয়ে কোরিয়ায় আছে। স্বামী এদিক ওদিক কাজ করে। রাশান পারে, তাই নানা ব্যাপারে রেনার হেল্প নিতো সবসময়। আড়াই বছর হয়ে গেছে তার ল্যাবে।

ডগসম বলোরামাঃ বলোরামা বলেই পরিচিত। মংগোলিয়ান এবং সব কিছু যায়ার মতই। শুধু সে বিবাহিতা না, এবং ভালো মেয়ে বা ভালো রিসার্চারও না, নারিকেল মাথা। সারাদিন সাজগোজ আর কুটনামীতে ব্যস্ত। ইংলিশে যায়ার চেয়ে কিছুটা ভালো। চেংগিস খানের বংশধর হিসেবে দাবী করা এই মহিলা ফাকিবাজিতে ওস্তাদ। সকালে প্রফেসর ল্যাবে আসা মাত্রই একটা বিকার বা কনিকেল ফ্লাস্ক নিয়ে বেসিনে গিয়ে ধোয়া শুরু করবে, যেনো অনেক সকাল থেকেই কাজ করে এখন ধুয়ে রাখছে। ল্যাবে আসবে সকাল ৮.১৫ এর দিকে, শীটে লেখবে ৭.৩০টা। তার এই আকামের সংগী যায়া। এজন্য ইসপেশাল ইনসেনটিভও পেতো, তবে স্বীকার করতো না। সব সময় গায়ে হাত দিয়ে কথা বলবে, হাত ধরে টানবে, এজন্য সবার ঝাড়ি খায়, একদিন আমি রেগে বাংলায় বলে উঠেছিলাম “ঐ গেলি”, তাও শোধরাবার কোন লক্ষন ছিলো না। ডঃ প্রকাশের দাবি, সে প্রফেসরের সাথেও এমন করে। ডঃ ইসমাইল পারলে এই মেয়েকে সব তুলে খাওয়াতো। একে নিয়ে আমরা হাসাহাসিই বেশি করতাম। এতে খেপতোও বেশি। যায়া আর সে একি সাথে কোর্স শুরু করেছে।


নটারান্জান ভালারমাথিঃ
ল্যাবের সবচে জুনিয়র পিএইচডি স্টুডেন্ট, ইন্ডিয়ান তামিল। আমরা একসাথেই শুরু করেছিলাম। ওর স্বামী ওখানেই আর এক ল্যাবে পোষ্টডক করতো, নিউলি ম্যারেড তখন। খুব ভালো মেয়ে, ভালো রিসার্চার। আমার বন্ধুর মত, ছোট বোনের মত। চুপচাপ নরম একটা মেয়ে আসার ৫-৬ মাস পরেই ঠোটকাটা-স্টাবোর্ন হয়ে গেলো। স্বামীর সাথে আলাদা বাসায় থাকলেও প্রফেসর ওর স্যালারি থেকে ডরম ভাড়া হিসেবে ১০০ ডলার কাটতো। সে এটার ক্লিয়ার করতে বলায় প্রফেসর সব দোষ কৃষ্ণার উপর দিয়ে ছিলো, অর্থ্যাৎ কৃষ্ণা নাকি ভুলে এটা ক্লিয়ার করে নি। ইয়াংজের কাছ থেকে ভালো কাজ শিখেছে, তাই প্রফেসরকে ও এখন আর তেমন পাত্তা দেয় না। এখনও আছে, কোর্স শেষ, রিসেন্টলি স্কলারশিপ পেয়েছে, তাই প্রফেসরের নিয়ন্ত্রন হতে মুক্ত। গ্রাজুয়েশনের ব্যাপারে সিরিয়াস না, স্বামী অন্য কোথাও চলে গেলে সেও চলে যাবে, এটাই তার ডিসিশন।

স্টাফঃ

মিসেস চোঃ প্রফেসরের সেক্রেটারী। ল্যাব টেকনিশিয়ান থেকে প্রমোশন পেয়ে এতদুর। ভালো মহিলা, তবে ইংলিশ এক বর্নও বুঝতে পারে কিনা সন্দেহ। আমি তাই তার সাথে বাংলায় কথা বলতাম, কারন সে ইংলিশ বুঝে না, আমি কোরিয়ান বুঝতাম না। তাই বাংলা আর ইশারাতে কথা হতো। হোসাঙ যদি প্রফেসরের ডানহাত-বামহাত হয়, মিসেস চো তবে তার অজুহাত। কারন সে ইংলিশ বুঝে না এই অজুহাতে ধরা পড়া সকল “ইচ্ছাকৃত ভুল”কে না বোঝার ভুল হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলতো। এখনও আছেন।


মিঃ সোঃ
সবার কাছে সিল চা নিম নামে পরিচিত হতে আগ্রহী, অর্থ্যাৎ নেতা। সে গ্লাসহাউসের কেয়ারটেকার, সাথে ল্যাবের বিভিন্ন মেরামতের কাজেও সে আছে। আগে ইউনিতেই কাজ করতো, অবসরের পর এই কাজে এসেছে। বুড়ো হলেও মনটা ইয়াং। এখনও ইন্টারনেট এর মাধ্যমে ইয়াং মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ওদের নিয়ে ডিনারেও যায়….., যদিও বিবাহিত, বউ জীবিত। ইংলিশ শেখার প্রানান্তকর চেষ্টা এই ৬০ এর বেশী বয়সেও, আমরা ছিলাম তার ইংলিশ শিক্ষক, সে ছিলো আমাদের কোরিয়ান ভাষার শিক্ষক। মনটা ভালো খুব, হাসিখুশি, দেখলেই বলবে চলো কফি খাই। আর আমাকে সব সময় বুদ্ধি দিতো বউকে আনার দরকার নেই, এখানেই একটা গার্লফ্রেন্ড জোগাড় করে সময়টা কাটাও, পরে দেশে ফিরে যেয়ো। প্রফেসরের একজন ইনফরমার ছিলো সে। গ্লাস-হাউসের গাছ-পালার যত্ন নিতো কম, অনেক সময় গাছে প্রসাব করে সারের ব্যবস্থা করতো। এখনও আছে।

হিয়োঙঃ ল্যাব অফিস স্টাফ। এই ল্যাব থেকেই মাষ্টার্স করেছে। ছেলে খুব ভালো , হেল্পফুল, আড্ডাবাজ, তবে সুজাতা দিদির স্যালারির টাকা মেরে দেয়ার জন্য এই ছেলেটার একাউন্ট নম্বর ব্যবহার করা হয়েছিলো। যদিও তার দোষ ছিলোনা বলেই জানি, সব প্রফেসরের বুদ্ধি। আমি থাকতেই অন্য চাকরী পেয়ে চলে গেছে।


কিরণঃ
কৃষ্ণার স্ত্রী, ল্যাবের টেকনিক্যাল স্টাফ। কমার্স গ্রাজুয়েট হলেও মলিকুলার বায়োলজি ল্যাবের ল্যাব টেকনিক-ইক্যুপমেন্ট গুলো সহজেই আয়ত্ত এনে ফেলেছিলো। তাই ল্যাবের অপরিহার্য হ্যান্ড ছিলো। খুব নরমাল, টিপিক্যাল একজন মহিলা, ভালোবাসা-হিংসা-বিদ্বেষ সব নিয়েই। আমি লাকি আমি তার ভালটাই পেয়েছি। খুব হেল্পফুল। এখন নেপালে ফিরে গেছে। এক মেয়ের পর এবার একটা ছেলে হয়েছে।

লায়লা খানমঃ ডঃ ইসমাইলের স্ত্রী। আরেকজন ল্যাব টেকনিক্যাল স্টাফ। মুল দায়িত্ব ছিলো ব্যবহৃত গ্লাস-ওয়্যারগুলো ধোয়া আর চাহিদা মত গবেষনার জন্য প্রয়োজনীয় গাছপালা লাগানো। খুব সাদাসিধা মহিলা। রেনাই একমাত্র বন্ধু তার। এখনও আছে।

অনেক বড় হয়ে গেলো। সরি…

পরের পর্বঃ আমার কোর্স এন্ড রিসার্চ এক্টিভিটিস-তিক্ততার নতুন পর্ব শুরু

No comments:

Post a Comment