প্রিয় উক্তি......

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়..........

Saturday, January 3, 2009

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (শেষ পর্ব)

ডেমকেয়ার লাইফ ও পলায়ন প্রস্তুতিঃ

আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কোরিয়ায় কাটানো শ্রেষ্ঠ সময় কোনটা? আমি নিদ্বিধায় বলবো অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত একমাস। প্ল্যান করা আর সে অনুযায়ী কাজ করে ১০০% সফল হওয়ার সময় সেটা।

অক্টোবরের ২৬ তারিখ খবরটা পাওয়ার পর শুরু হলো গোপনীয়তা রেখে, কোনরুপ সন্দেহ না জাগিয়েই দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া। আসল ব্যাপারটা টের পেলে আটকে দেবে। অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে এক নেপালী স্টুডেন্টের সংগে, চলে যেতে চেয়েছিলো বলে মিথ্যা অভিযোগে পুলিশে দিয়েছিলো। সুজাতা দিদি আর কৃষ্ণা-কিরনকে জানিয়েছিলাম। ওরা নানা ল্যাব টেকনিক দ্রুত শিখিয়ে দিচ্ছিলো। কিন্তু প্লেনের টিকিট কাটা, রেনা-বলোরামার সন্দেহ না জাগিয়ে ডরমেটরী থেকে ব্যাগ এন্ড ব্যাগাজ বের হয়ে আসা, কেনাকাটার জন্য দেশি লোকদের হেল্প ছাড়া সম্ভব ছিলো না।

আগের বার দেশে যাবার সময় রাউন্ড ট্রিপের টিকেটের ফটোকপি ল্যাবে জমা দিতে হয়েছিলো, এবারও হবে। কিন্তু আমি তো এবার করবো ওয়ান ওয়ে টিকিট। ওরা ওয়ান ওয়ের টিকেট দেখলে সন্দেহ করবে যে আমি আর ফিরবো না। একটু দু’নম্বরী করলাম। প্রথমে রিজারভেশন দিলাম রিটার্ন সহ। রিজারভেশনের ডকুমেন্টটা ফটোকপি করে রেখে পরদিন আবার গেলাম ট্রাভেল এজেন্সীতে রিটার্ন ক্যানসেল করে ওয়ানওয়ের জন্য। ফিরিয়ে দিলাম আগের মুল ডকুমেন্টটা। এক সপ্তাহের মধ্যে টিকেট নিতে হবে, ঐ সময় টাকা হাতে নেই তেমন, ধার নিলাম এক ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে। ২০ তারিখে স্কলারশীপের টাকা পাবোই, তখন দিয়ে দেবো। টিকিট কেটে রেখে দিলাম, নভেন্বরের ২৬ তারিখ, রবিবার।

ঐ সময়টাতে ল্যাবে একটু ড্যাম কেয়ার ভাবে চলেছি। ওরা যা বলে তাই “ওকে” বলে সটকে পড়ি। তেমন কোন কাজ করি না, আর সুযোগ পেলেই বিভিন্ন সেমিনার-কনফারেন্সে যাই, নতুন জায়গা দেখার জন্য। আসলে সম্পর্ক মেরামতের জন্য প্রফেসর আমাকে বিভিন্ন জায়গায় নিতে চাইতো। যেখানে আগের ৯ মাসে ইউনি ছাড়া দুরে কোথাও নেয় নি কোন কনফারেন্সে, সেখানে শুধু নভেম্বরেই বুসান থেকে অনেক দুরে ২টা সিটিতে দুটি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স!

আরেক ক্যাম্পাসে কিছু ধানের মিউট্যান্ট এর বীজ লাগিয়েছিলাম কয়েকমাস আগে, নভেম্বরে সেসব হারভেষ্ট করে শুকিয়ে প্যাকেট করার কাজও করতে হলো। তাই ল্যাবে থাকি কম এই অযুহাতে।

এবার ডরমেটরী ছাড়ার পালা কোন সন্দেহ না জাগিয়ে। ল্যাবে একদিন ঘোষনা দিলাম আলাদা বাসা পেয়ে গেছি, এক বন্ধুর সাথে আপাতত থাকবো, পরে ফ্যামিলি নিয়ে থাকবো। এক শনি-রবিবার ঘোষনা দিয়ে নিজের সব কিছু নিয়ে এক ছোট ভাই সহ রওনা দিলাম আরেক বন্ধুর বাসায় (সে বিয়ে করতে তখন দেশে, চাবি আমার কাছে।), তাকে ফোনেই বলে রেখেছিলাম।

এমন ড্যাম কেয়ার স্টাইলে চলায় ল্যাবে অনেকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়, কোন সুত্র পায় না। ওদিকে দিদি আর কৃষ্ণাদার সব জেনেও না জানার ভাব করে আমাকে সাহায্য করতে থাকে। এর মধ্যে হিন্দি শেখানোর একটা টিউশনী পাই, ঘন্টায় ১৫ ডলার, সপ্তাহে ৪ ঘন্টা। এক কোরিয়ান স্কুল টিচার ভারতে যাবে বেড়াতে, সে জন্য শিখতে চায়। ল্যাবমেট রেনার সাথে কিভাবে যেন পরিচয়, সে আমার জন্য যোগাড় করে দিলো। আমি আর নিলাম না, বল্লাম একটু দেশে যেতে পারি, ফিরে এলে পড়াবো, নাইলে অন্য কাউকে রিকমান্ড করে যাবো। আমি চলে আসার পর নেপালী কৃষ্ণাই শিখাতো।

সময় এগিয়ে আসতে থাকে, আমার প্রস্তুতি চলতে থাকে, কেনাকাটা, সব গুছানো। ল্যাবে হাতের কাজ গুলো গুছিয়ে দেয়া যেন চলে যাবার পর আমার জন্য কৃষ্ণার সমস্যা না হয়। ইউএনডিপি’র একটা প্রোগ্রামের আওতায় কয়েকটা কোরিয়ান স্কুলে বাংলাদেশের উপর পরিচিতিমুলক ক্লাশ বাকি ছিলো, সিডিউল অনুযায়ী দ্রুত শেষ করলাম, নতুন ক্লাশ নিলাম না। বুসানের বাংলাদেশীরা এসব ক্লাশ নিতে উৎসাহী ছিলো না, তাই আমিই নিতাম অনেক।

সব ঠিক প্ল্যান অনুযায়ী এগোলেও আসল সমস্যা প্রফেসরকে দেশে যাবার কথাটা বলা। মাত্র কয়েকমাস আগে গিয়েছি, এদিকে টাকা নিয়ে প্রতিনিয়ত গ্যান্জাম হয় প্রফেসরের সাথে, এর মধ্যে আবার টাকা খরচ! সুতরাং তাকে রাজী করানো সহজ না। বাবা-মা-বউ কাউকে অসুস্থ বানাতে হবে অযুহাত হিসেবে, যদিও প্রিয় মানুষগুলোকে মিথ্যা অসুস্থ বানাতে ইচ্ছা করে না। আগে এক পাকিস্তানী ছাত্র ল্যাব থেকে পালিয়েছিলো বাবাকে অসুস্থ করে, তাই এটা কেমন কাজ করবে তা নিয়েও সন্দেহ। যেতে হবেই, আমি ডেসপারেট, রাজি না হলে না বলেই…।

দেশের যাবার কথা বলার জন্য ডেট ঠিক করলাম ১৭ নভেম্বর, শনিবার। সেদিন সবাই মিলে ল্যাবের গ্লাস-হাউজ পরিস্কার করবো, এমনদিনে প্রফেসরের মন-মেজাজ ভালো থাকে। কিন্তু তবুও টেনশনে আছি, বাবা নাকি মা নাকি বউকে অসুস্থ বানাবো। অযুহাত খুজছি মন মত। মিথ্যা খুব ভালো বলতে পারি না। ধরা খাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।

১৫ নভেম্বর রাতে দেশে সিডর বয়ে গেলো। মনটা স্বভাবতই খারাপ। এত ক্ষয়ক্ষতি সারা দেশে! পরিবারের সবাই ঢাকায়, দেশের বাড়ীও উত্তরবংগে, তাই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত কেউ হয় নি, এটাই শান্তি। ১৭ তারিখ কৃষ্ণার বাসায় সকালে নাস্তা করছি, ওখান থেকেই ল্যাবে যাবো দুজন। টিভিতে সিডর এর ভয়াবহতা দেখছি। কৃষ্ণা জিজ্ঞেস করে, দেশে সবাই ভালো তো? আমি উত্তর দেই, হ্যা ভালো! পরিবারের কেউ তো দক্ষীনে থাকে না। কৃষ্ণা মিটিমিটি হাসে আর বলে, “কেমনে ভালো? দেশে তো সবাই তো তোমার পরিবারের মত”। আমি ওর হাসির অর্থ ধরতে পারছি না। কিরন চা দিতে এলো, সেও হেসে বল্লো, বুঝো নাই কৃষ্ণার কথা? আমি বুঝে গেলাম কি করতে হবে।

গ্লাস-হাউজে কাজ শেষ করে ওয়েট করছি কখন প্রফেসর আসবে, সে এলো না। ভালই হলো, সামনি সামনি মিথ্যা বলা খুব কঠিন। আমি ফোন করলাম প্রফেসর কে। তাকে বল্লাম, “তুমি তো জানো বাংলাদেশে সাইক্লোন বয়ে গেছে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, আমার একবার দেশে যাওয়া দরকার”। এমন বিশ্বাসযোগ্য কারন আর আছে! এমন মানবিক আবেদন! সে রাজী তবে ১৯ তারিখ আবার কথা বলতে বল্লো। আমি বেজায় খুশি। খুশি দিদি আর কৃষ্ণাও।

১৯ নভেম্বর, সোমবার সকালেই আগের ফটোকপি করে রাখা রিটার্ন ট্রিপের রিজার্ভেশনের কাগজে ইস্যুর তারিখের জায়গায় ১৯ নভেম্বর বসিয়ে ফটোকপি করলাম। প্রফেসর দুপুরে এলো, আমি খুব ব্যস্ত ভাব দেখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তার কাছে যাই না। কারন, মিথ্যা বলতে হবে সামনা সামনি, আমার জন্য খুব কঠিন। আর এক মিথ্যা ঢাকতে আরো মিথ্যা বলতে হয়। ধরা পড়ার চান্স বেশি। প্রফেসর অনেকক্ষন ওয়েট করে একসময় নিজেই ডাক দিলো, গেলাম, যথাসম্ভব কম কথায় উত্তর দিয়ে বলে, মুখটা দুঃখী দুঃখী ভাব করে পার পেয়ে গেলাম।

ল্যাব মেম্বাররাও জেনে গেলো আমি যাচ্ছি সাইক্লোনের কারনে পরিবারের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে। এই আর এক জ্বালা, মুখে সারাক্ষন দুঃখী ভাব ধরে রাখতে হয়। ডঃ প্রকাশ অবশ্য সন্দেহ করেছিলো, বলেই ফেল্লো, “তোমাকে গত একমাস ধরে এত রিল্যাক্স দেখাচ্ছে কেন? আবার দেশে যাবা?” আমি কেটে পড়ি, শোকে-দুঃখে-দুঃশ্চিন্তায় কাবু হবার ভাব ধরে সময়টা পার করি।

সব প্রস্তুতি নিয়ে ২৬ নভেম্বর, রবিবার বিকালে রওনা দিলাম বুসানের গিমহে এয়ারপোর্টের দিকে। সেদিন সকালে ঘুরে বেড়িয়েছি ক্যাম্পাসে এক ছোট ভাইয়ের সংগে, ছবি তুলেছি রাজ্যের, দুপুরে দাওয়াত ছিলো আর এক ক্লোজ ফ্রেন্ডের বাসায়। এয়ারপোর্টে আমার সাথে গেলো আসাদ, চুয়েটের। খুব হেল্প করেছে শেষ পর্যন্ত। এয়ারপোর্ট থেকে ফোনে শেষবারের মত আবার কয়েকজনের সাথে কথা বলি, এরপর থাই এয়ারলাইন্সে চেপে বসি আমার বাংলাদেশের উদ্দেশ্য। এ ফিরে যাওয়া বড় আনন্দের, বড় আকাংখিত। দেশে প্রবেশ করলাম চট্টগ্রাম দিয়ে, নিচে তখন সিডর বিদ্ধস্ত গ্রাম আর আকাশে স্বর্নালী সুর্য।

কোরিয়ায় আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা বেশি হলেও সুখ স্মৃতিও অনেক।

দেশটা সুন্দর, সাধারন মানুষ গুলো হেল্পফুল। বিশেষ করে বুড়ো-বুড়িরা। বিদেশী ছাত্রদের খুব খাতির করতো এরা। কম দামে বেশি সব্জি দিয়ে দিতে বুড়ো সব্জিবিক্রেতা, অনেক সময় ফল-টল ফ্রী দিয়ে দিতো। ট্রেনে ভ্রমনের সময় সীটের অভাবে দাড়িয়ে আছি, বুড়ো কোন আজাস্সি (বিবাহিত/বয়স্ক লোক) এসে তার সাথে বয়স্কদের সীটে বসার জন্য জোরাজুরি করতো। বা সেই স্কুল টিচাররা- বাসা ম্যাম, কিম হিয়াং ম্যাম, মার্কোস, এরা নিজের গাড়ি দিয়ে উইকেন্ডে ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইতো, গিয়েছি কয়েকবার। স্কুলের সেই চঞ্চল বাচ্চারা, এখনও যোগযোগ আছে ইমেইলে ওদের একজনের সাথে। কিংবা “বুসান বুদ্ধিজম” এর সদাহাস্যময় কিম মুন, বিভিন্ন ঐতিহাসিক-ধর্মীয়-দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়ানোতে সেই অক্লান্ত সংগী বিদেশীদের। এদের কথা ভুলি কি করে? এদের কথা মনে পড়লে কোরিয়া আর এর মানুষদের খারাপ বলি কিভাবে। তবে ওভারঅল প্রবীন উচ্চ শিক্ষিত ও ইয়াং কোরিয়ান জেনেরেশন কম সহনশীল, নাক-উচু স্বভাবের। এদের কমনসেন্স কম। এবং এদের বোকা বানানোও তাই সহজ, কারন এরা নিজেদের খুব বুদ্ধিমান মনে করে। আবার ব্যতিক্রম আছে, ঐ একই ইউনির প্রফেসর ইয়াং জিন-কিম বা কাঙ হো ইয়াং, এরা ছিলো অসাধারন মানুষ, শ্রদ্ধা যেমন করতাম, তেমন স্নেহও পেয়েছি এদের কাছ থেকে।

বিদেশীদের মধ্যে সুজাতা দিদির দিদিসুলভ ভালোবাসা। নারিকেলের নাড়ু-বেগুনী-নুডলস-মুড়ি-চানাচুর-সেমাই-লাড্ডুর নিয়মিত সাপ্লাই, যেন স্বাদ ভুলে না যাই। বিদায়ের শেষ মুহুর্তে তার কান্না…..। ভোলা কঠিন। কিংবা কৃষ্ণা-কিরনের নিরন্তর সাহায্য-আতিথেয়তা, সব ধরে ধরে শিখানো। ওদের মেয়ে স্নেহার দুষ্টুমি।

ওখানেও হৃদয়ে ছোট্ট বাংলাদেশ নিয়ে ছোটাছুটি, বাংলাদেশিদের সাথে আড্ডা-পিকনিক-ইফতার পার্টি-ঈদ পার্টি। রাত জেগে শাবি’র শামীম (ব্লগেই আছেন), মুজিব এর সাথে আড্ডা আর মনোপলি খেলা ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত। কখনও সবার ছোটভাই চুয়েটের কফিল এসে যোগ দিতো। কখনও বা রাত ৯টার দিকে বের হয়ে পুল খেলা-রাস্তায় জুস নিয়ে হেটে হেটে আড্ডা। উইকেন্ডে দলবেধে মার্কেটে ঘোরাঘুরি, শামীম ভাইয়ের বিয়ের বাজার করা। হৈ-চৈ কৌতুক, একে ওকে পচানো। আর তাবলীগ আসাদের গার্জিয়ান ভাবটাও এনজয় করতাম। শাবি’র জগন্ময়-সেলিনা জুটির জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে ডালপুরী খাওয়ানো। অনেক দিন কচু খাইনা শুনে করিম ভাই-দীপ্তি ভাবীর দাওয়াত দিয়ে কচুর অনেক আইটেম খাওয়ানো। চাটগায়া আকবর ভাইয়ের “বদ্দা” সুলভ ভালোবাসা আর দাওয়াত খাওয়ানো……. এসব কিছুই আনন্দের….মিস করি খুব।

অনেক বড় হয়ে গেলো, তবুও মনে হয় আরও লেখার ছিলো, আরও বলার ছিলো। কিন্তু পাঠকের বিরক্তি আর না বাড়িয়ে শেষ করছি এখানেই। কোরিয়ায় থাকা পুরো সময়টার অনেক টুকরো স্মৃতি আছে, আনন্দের-কষ্টের। সুযোগ পেলে পরর্বতীতে লেখবো।

এতদিন সাথে থাকার জন্য সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

1 comment:

  1. Nice Content. Do you want to know about the First tuition media center in Bangladesh? "Tuition media" is the first tuition media center in Bangladesh which is offering best quality tuitions.

    Become a tutor in tuition bd you need to contact with us.

    Want to get everyday tuitions notification?

    Just visit our website or install our tuition media app in your Android smart phone from Google Play Store to get everyday tuition.

    ReplyDelete