প্রিয় উক্তি......

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়..........

Friday, January 2, 2009

কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনাঃ আমার (তিক্ত) অভিজ্ঞতা (পর্ব-৯)

আমার কোর্স এন্ড রিসার্চ এক্টিভিটিস-তিক্ততার নতুন পর্ব শুরুঃ ৩য় কিস্তি

মনে রাগ নিয়ে দেশে ফিরলাম। ২৮ জুন রাতে ঢাকায়। কষ্টগুলো কাউকে বল্লাম না, গেছি লেখাপড়া করতে, এত কষ্ট করেছি বলি কিভাবে? সময়ও হাতে বেশি নেই, জুলাইয়ের ১৫ তারিখে ফিরতে হবে আবার। বাসার সবার হাসি-খুশি মুখ- আমার ফেরার আনন্দ, আমাদের অনাগত সন্তান আর আমার ভাইয়ের বিয়ে, আনন্দের কত উপলক্ষ্য! আমি সব ভুলে আনন্দে সামিল হই। বউকে ডাক্তারের কাছে নেয়া-আল্ট্রাসোনো, ভাইয়ের বিয়ের প্রস্তুতি নেয়া-হইচই-আমি ছাড়া বিয়ের গেট ধরবে কে? মাঝে একবার ঘুরে এলাম কর্মস্থলে, ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়ে এলাম কোরিয়ায় কিছু সমস্যার কথা, যেন ভবিষ্যতে সহায়তা পাই।

ঝড়ের বেগে আনন্দের দিন গুলো শেষ হতে থাকে, কৃষ্ণার ইমেইল পাই “আনেকা টাইম তো হো গেয়া ব্রো..”। প্রফেসরেরও একটা ইমেইল পাই, তবে সেটা অন্য বিষয়ে, সব ল্যাব মেম্বারদের জন্য গণমেইল। আবার ফিরে যাওয়া কষ্টের জীবনে, যেখানে শুধু একটাই আশা, স্কলারশীপ! ফিরে গেলাম কোরিয়ায়, পৌছালাম ১৫ জুলাই। নিজের বাসায় না ফিরে ইউনির কাছেই থাকা দেশি দু’বন্ধুর বাসায় উঠে রাতটা কাটালাম, সবাই মিলে দেশ থেকে আনা খাবার-দাবার সাবাড় করলাম, আনন্দকে একটু দীর্ঘায়িত করা আর কি!

পরদিন, ১৬ জুলাই ছিলো সোমবার, তবে কোন কারনে ছুটি ছিলো। ল্যাবে গেলাম দুপুরের দিকে, সবাই নেই। কৃষ্ণা-কিরন-দিদি। আর প্রফেসর ও তার চ্যালা হোসাং। আমাকে দেখে প্রথম ৩জন তো খুশিই, তবে আমাকে অবাক করে প্রফেসর আর হোসাংও খুব খুশি। প্রফেসর বলে “ওয়েলকাম ব্যাক!”, হোসাং বলে “কেমন কাটলো, সবাই কেমন….।” আমি কিছুটা বিভ্রান্ত। তবে তারা মনে করেছিলো আমি নাকি আর ফিরবো না, তাই ফিরতে দেখে হাপ ছেড়ে বাচলো।

আগের পর্বে একটা তথ্য দিতে ভুলে গেছি। এপ্রিল মাসে প্রফেসর একটা বড় প্রজেক্ট হারিয়েছে। বাজেট আর লেন্থ দু’দিকেই বড়। ২০১২ পর্যন্ত ছিলো, কিন্তু আগের ৫ বছরের প্রগ্রেস ভালো না হওয়ায় আর এক্সটেন্ড করে নি। এটা ল্যাবের জন্য একটা বিশাল ধাক্কা। কারন এই প্রজেক্টের টাকা দিয়ে ল্যাবের অনেক খরচ চালানো হত। আসলে আগের ৫ বছরে ল্যাবের উল্লেখযোগ্য কোন ভালো পাবলিকেশন নেই। তাই এটাই স্বাভাবিক। আমি দেশে থাকতে প্রফেসরের যে মেইল পেয়েছি সবার সাথে, সেটা ছিলো “সবার জন্য করনীয়” টাইপের। সেখানে সব ল্যাব মেম্বারকে আরো সিরিয়াস ও রেগুলার হতে বলা হয়েছিলো, এবং না হলে স্যালারি আরো কমিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিলো। বিশেষ করে ২জন রিসার্চ প্রফেসর ও ২ জন পোষ্টডক-কে স্যাক্রিফাইসের জন্য তৈরি থাকতে বলা হয়েছিলো। কি ধরনের স্যাক্রিফাইস তা গিয়ে টের পেলাম।

প্রফেসর ঐ ৪জন, হোসাং আর কৃষ্ণাকে নিয়ে মিটিং করলো, কৃষ্ণাকে নেয়ার কারন সে ল্যাব এক্টিভিটিস এর লিডার, আর সে দিদিকে কনভিনস করতে পারবে। মিটিং ঐ ৪ জনকে ৫০০ ডলার করে দিতে বলা হলো প্রতি মাসে, ল্যাবের জন্য। ডঃ ইসমাইলের ভিন্ন ইকুয়েশন আছে, সে রাজি। দিদি “না” বল্লো, তাকে ডবল ফেলোশীপের লোভ দেখানো হলো, সে বলে দিলো সে বেশি চায় না, যা আছে তা নিয়েই শেষ করতে চায়। ডঃ প্রকাশ ষ্ট্রংলি “না”, আর বাসু প্রথমে “হ্যা”, পরে আসল জিনিসটা বুঝতে পেরে “না”। শেষোক্ত তিন জনের “না” তে জমে উঠলো খেলা। কারন প্রফেসর “না” শোনার আশা করেনি। সে ভয়ানক ক্রুদ্ধ! বিদেশীরা বেশি টাকা নেবে আর তাকে কষ্ট করে আরো ফান্ডিং খুজতে হবে, কিভাবে হয়! এর মাঝে আমি যদি স্কলারশীপ পাই, তবে ল্যাবে এক্সট্রা টাকা আসবে, আমার ফিরে আসায় খুশি আসলে এজন্যই।

ইউনিতে তখন সামার ভ্যাকেশন, ক্লাস শুরু হবে সেপ্টেম্বর থেকে। ল্যাবে তখন ঢিলেঢালা অবস্থা। প্রজেক্ট হারিয়ে প্রফেসর একটু ল্যাবে অমনোযোগী, এই সুযোগে সবার আনন্দ। যেনো কোন প্রাইমারী স্কুলের ক্লাশরুম। মাষ্টার থাকলেই সব ঠিক, না থাকলেই হইচই। আমিও রিল্যাক্স। দেশিদের সাথে রাত জেগে মনোপলি, সময় করে বিলিয়ার্ড খেলতে যাওয়া-ইউনির মেইন গেটে আড্ডা মারা আর উইকেন্ডে বড় মার্কেটগুলোতে ঘুরাঘুরি। একজন আবার পিএইচডি শেষ করে দেশে বিয়ে করতে যাবে, সেখান থেকে অষ্ট্রেলিয়া, তার জন্য কেনাকাটা সবাই মিলে।

ওদিকে সুওনে থাকা আমার বন্ধুর অবস্থা খুব খারাপ, ল্যাবমেটদের সাথে প্রতিনিয়ত ঝামেলা, বাইরে এমনকি বাথরুমে যেতে হলেও ল্যাবলিডারকে (ওরা বলতো ক্যাপ্টেন!) বলে যেতে হবে, কেউ দেখা করতে আসতে পারবে না… ইত্যাদি। সে লুকিয়ে দেশে চলে যাবে জুলাইয়ের ২৫ তারিখ, আমি বলি আর একটু দেখ! স্কলারশীপের রেজাল্ট হলো বলে!

অবশেষে স্কলারশীপের রেজাল্ট হলো জুলাইয়ের ২৪ তারিখে। আমি স্কলারশীপ পেয়েছি, আমার বন্ধুও। সে আর দেশে ফিরে যাবে না, তার প্রফেসরের সাথে কথা হয়েছে। আমার কথা তো আগেই হয়ে আছে, স্কলারশীপ পেলে আমার টিউশন ফি দিয়ে দিবে, পুরোটা আমার। কৃষ্ণাও মনে করে যে দিবে। কারন আগে এক পাকিস্তানী ছাত্র ল্যাব থেকে না বলে চলে গেছে এই নিয়ে গ্যান্জাম করায়। সো, আমার বেলা ভুল করবে না।

স্কলারশীপের খবরটা বগলদাবা করে প্রফেসরের কাছে যাই, খুশির খবর দেবো, আর তার সাথে মনে করিয়ে দেবো এগ্রিমেন্ট এর কথা। জানালাম, সে দাত বের করে হাসি দিলো, “ওকে! ওকে!”। আমি বল্লাম টিউশন ফি’র কথা। সে নির্বিকারভাবে বলে দিলো “দেয়া সম্ভব না, কারন তাতে তুমি অন্যান্য স্টুডেন্টদের চেয়া অনেক বেশি পাবে, একি ল্যাবে এটা ঠিক না। তাহলে ওদের স্যালারীও বাড়াতে হবে।” আমার প্রচন্ড রাগ উঠলো, এটার জন্য এতদিনের প্রতীক্ষা, আর সে বলে কি?

আমি তখন মরিয়া, বলি “তুমি তো জেনেই এই কথা দিয়েছো, এখন কেনো এ কথা বলছো?” নির্লজ্জের মত সে বলে চল্লো, “তুমি যদি একজন পোষ্টডকের কাজ গুলি করো, তাহলে আমি তোমাকে এক্সট্রা পে করবো”, এটা আমাকে দুর্বল করে দেয়ার চেষ্টা। অথচ আমি একজন পিএইচডি স্টুডেন্ট হয়ে পোষ্টডকের কাজগুলো করবো কিভাবে? আমি বুঝলাম সে এলোপাথাড়ি যাচ্ছে, নিজের ভুল স্বীকার না করে, টিউশন ফি না দেয়ার জন্য একের পর এক উল্টাপাল্টা যুক্তি দেখাবে। আমি নিজের মধ্যে দুর্বিনীত রাগ টের পাই, বলি, “তাহলে তো সমস্যা। কারন ফ্যামিলি ছাড়া আমার পক্ষে থাকা আর কাজে কনসেন্ট্রেট করা সম্ভব না, আর এইটাকায় ফ্যামিলি নিয়ে থাকাও সম্ভব না”। সে সমাধান দিলো,”তোমার ১ সিমেস্টার শেষ, আরো ৩টা শেষ করে ফ্যামিলি আনো, তখন টিউশন ফি লাগবে না, পুরোটাই কাজে লাগবে তোমার।” আরো ৩ সিমেস্টার মানে আরো ১ বছর ৬ মাস! বলে কি!

সে টোপ দেয়, “তুমি যখন ফ্যামিলি আনবে তখন আমি আরো হেল্প করবো, আর এখন ভালো কিছু পেপার করো, আমি ইনসেনটিভ দিবো”। এতদিনের দেখা স্বপ্নগুলো ভেংগে চুরমার, স্কলারশীপ পেয়েও লাভ হলো না? তবে ভালো দিন আসবে কবে? আর তো বিশ্বাস করা যায় না। প্রফেসর ভবিষ্যতে আমার জন্য আর কি কি করবে তার ফিরিস্তি দিয়ে যাচ্ছে, দিয়ে যাচ্ছে আশ্বাসের বানী। আমি রাগে কাপতে কাপতে চলে আসলাম তার সামনে থেকে। সে ক্ষেপে গিয়ে পেছন থেকে ডাকছে, আমি শুনলাম না। আবার সেই প্রথমদিককার মত সাহস ফিরে পাচ্ছিলাম।

পরবর্তি কয়েকটা দিন খুব দ্রুত কিছু ডিসিশন নিলাম, সুজাতাদিদি আর দেশি বন্ধুরা হেল্প করলো ডিসিশন নিতে। অন্যান্য দেশে স্কলারশীপের জন্য এ্যাপ্লি করবো। ডরমেটরিতে ইন্টারনেট লাইন আছে, আর ওখান থেকে ইয়াংতে চলে গেছে নতুন বাসা নিয়ে, সো আমিই একা নীচতলায়। ইয়াংতে কম্পিউটার এর পার্ট-টাইম ব্যবসাও করে, খুব কম দামে ওর কাছ থেকে একটা সিপিইউ কিনলাম, ৮০ ডলারে। মনিটর, কি বোর্ড, মাউস, স্পিকার যোগাড় হয়ে গেলো। সিভি টা আরেকটু মেরামত করে আকর্ষনীয় করা হলো, অষ্ট্রেলিয়ায় যে চলে যাবে, সে হেল্প করলো ওটা করতে।

আমি ফাকি দেয়া শুরু করলাম ল্যাবে, সকালে ল্যাবে এসে আবার বের হয়ে চলে যাই বাসায়। ইমেইল করা শুরু করলাম রিলেটেড লাইনের প্রফেসরদের। ল্যাব থেকে করলে ধরা খেতে পারি, তাই। টাইমশীটে আমি ল্যাবে আসার টাইম লিখিনা, ল্যাব মিটিং এ কোন কিছু প্রেজেন্ট করি না, নানা অযুহাতে এড়িয়ে যাই। কোন প্রজেক্টের কাজ করি না, কৃষ্ণার সাথের প্রজেক্টগুলো ছাড়া। মান্থলী রিপোর্ট জমা দেই না জুলাইয়ের। প্রফেসরকে দেখাই আমার রাগ-বিদ্রোহ, যেহেতু দোষটা তার, তাই কিছু বলে না, দেখেও না দেখার ভান করে।

আমি এই সুযোগে নিজের কাজ করে যাই। অষ্ট্রেলিয়া থেকে রেসপন্স পাই। ইউনভারসিটি অব এ্যাডিলেড আর ইউনিভারসিটি অব ওয়েস্টার্ন অষ্ট্রেলিয়া (UWA) থেকে , এ্যাডিলেডে এ্যাপ্লাইয়ের জন্য হাতে খুব কম সময় ছিলো, করা হয় না। UWA-তে IPRS স্কলারশীপের আবেদন করতে হবে অগাষ্টের ১৫ তারিখের মধ্যে। খুব দ্রুত ব্রিফ একটা প্রোপোজাল লিখে পাঠাই, ওখানে থেকে গ্রীন সিগন্যাল আসে, “গো এ্যাহেড!”। অনলাইনে এ্যাপ্লাই করি, ডকুমেন্টস পোষ্টে পাঠাই। ইউনিভারসিটি অব ওলংগাং থেকে আর একটা রেসপন্স পাই, ওটার এ্যাপ্লাই করতে অনেক সময় পাবো, অক্টোবরের ৩১ তারিখ, দেখা যাবে বলে আপাতত রেখে দেই।

আমার এসব কাজ দেখে সুজাতাদিদি আর কৃষ্ণাদা ভয় পায়, বলে, সাবধান, ল্যাবে সময় দাও, এত বেপোরোয়া হয়ো না। আমি আবার থিতু হই, ল্যাবে আগের মত আসতে থাকি, তবে ল্যাব মিটিং এ ফাকি দেয়া চলতে থাকে। কৃষ্ণার চাপাচাপিতে প্রজেক্টের কাজ শুরু করি, সে বুঝায় “তোমার অন্য দেশে স্কলারশীপ হবেই তা ভাবছো কেন? কাজ করতে থাকো এখানে, হলে চলে যাবে, না হলে এই সময়টা যেন নষ্ট না হয় সেটা দেখো”। কথা ঠিক! কাজ শুরু করি।

এদিকে স্কলারশীপ পেয়েছি বলে ল্যাব থেকে স্যালারী বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, অথচ স্কলারশীপের টাকা পাওয়ার কোন নামগন্ধও নেই। তাই অগাষ্টে টাকা নেই। মান্থলী রিপোর্ট দেই নি, তাই জুলাইয়ের বেতন দিবেনা, আমার অবস্থা তো খারাপ। প্রফেসর আমাকে এভাবেই শায়েস্তা করবে মনে হচ্ছে। কিন্তু বল হঠাৎ আমার কোর্টে, আগের মত ভুল করে হঠাৎ কিছু টাকা আমার একাউন্টে জমা হলো, যথারীতি বলা হলো টাকাটা তুলে দিতে। আমি আর নড়িচড়ি না, গড়িমসি করি, বলি টাকা নেই, খরচ করে ফেলেছি। ওরা অক্ষম রাগে কাঁপে। বাধ্য হয়ে ওটাকেই আমার স্যালারী হিসেবে দেয়া হলো। সেবার মান্থলী রিপোর্ট ছাড়াই আমার স্যালারি হলো। ল্যাব রুলকে বৃদ্ধাংগুলি প্রর্দশন, ল্যাবমেম্বারদের কাছে আমি স্রেফ হিরো, হোসাং বাদে।

অগাষ্টের ২৭ তারিখে একটা বিশাল সুখবর পেলাম, জীবনের সবচে আনন্দের খবর, আমি মেয়ের বাবা হয়েছি। আবেগে আপ্লুত হই, আনন্দে ভাসি, না থাকতে পারার কষ্টে জেরবার হই, চোখের পানি মুছে কয়েক টিন রসগোল্লা কিনে দেশি সবাইকে নিয়ে উল্লাস করি। আমার বাবা বলে দেশ থেকে, “তোমার সুদিন আসছে! প্রথমে মেয়ে হয়েছে, সৌভাগ্য আসবেই”। আমি আশায় বুক বাঁধি।

চলবে………..।

No comments:

Post a Comment